শনিবার (২১ সেপ্টেম্বর) সুপ্রিম কোর্টের ইনার গার্ডেনে সারাদেশ থেকে আসা দুই হাজার বিচারকের উপস্থিতিতে এ রোডম্যাপ ঘোষণা করেন বিচার বিভাগের প্রধান। এসময় করতালি দিয়ে রোডম্যাপ ঘোষণাকে স্বাগত জানান বিচারকরা।
প্রথমেই প্রধান বিচারপতি তার দায়িত্ব গ্রহণের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলেন, ‘রাষ্ট্রব্যবস্থার এক যুগ-সন্ধিক্ষণে আমাকে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের জন্য যে কঠিন বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব ছাত্র-জনতার এই বিপ্লবের কারণে আমার ওপর অর্পিত হয়েছে, সেই দায়িত্ব সততা, দক্ষতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ আপনারা-আমার বিচার বিভাগীয় সহকর্মীরা।’
তিনি ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের আমলের বিচার বিভাগের চিত্র তুলে ধরে বলেন, ‘বিগত বছরগুলোতে বিচার বিভাগের ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপ করা হয়েছে। ন্যায়বিচারের মূল্যবোধকে বিনষ্ট ও বিকৃত করা হয়েছে। শঠতা, বঞ্চনা, নিপীড়ন ও নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে বিচার বিভাগকে ব্যবহারের চেষ্টা করা হয়েছে। এতে বিচার বিভাগের ওপর মানুষের আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। অথচ বিচার বিভাগের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা হচ্ছে মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস। তাই নতুন এই বাংলাদেশে আমরা এমন একটি বিচার বিভাগ গড়তে চাই যেটি বিচার এবং সততা ও অধিকারবোধ এর নিশ্চয়তার একটি নিরাপদ দুর্গে পরিণত হবে। আমি আপনাদের Fiat justitia, ruat caelum এই প্রবাদটির কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, যার অর্থ হলো- ‘Let justice be done, though the heavens fall।’ আমাদের সামনে এখন যে বাধাগুলো রয়েছে সেগুলোর মুখোমুখি দাঁড়িয়েই আমাদের নতুন ভোরের শপথ নিতে হবে এবং নতুন যাত্রার সূচনা করতে হবে।’
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘যে ন্যায়ের আকাঙ্ক্ষা বুকে ধারণ করে লক্ষ জনতা এ দেশ স্বাধীন করেছিল তা বাস্তবায়নের জন্য অপশাসন রুখে দিয়ে নতুন দেশ ও জাতি গঠনের গুরু দায়িত্ব আমাদের ওপর অর্পণ করেছে বিপ্লবী ছাত্র-জনতা। এই লক্ষ্যে আমাদের এখন জন উত্তাপের এই দৃষ্টিকোণ থেকেই ভাবতে হবে যে, কেন বিচার বিভাগের এই ছন্দপতন হয়েছিল। কী কী বিষয় এর জন্য দায়ী। এই পথে কী কী প্রতিবন্ধকতা আছে, সেগুলো আমাদের চিহ্নিত করতে হবে। তারপর আমাদের কাছে কী কী জনসম্পদ ও অবকাঠামোগত সুবিধা-অসুবিধা রয়েছে তা নতুন করে মূল্যায়ন করতে হবে এবং এই জাতীয় দুর্বিপাক থেকে উত্তরণপূর্বক একটি জনমুখী আইন ব্যবস্থা ও বিচার কাঠামো বিনির্মাণে করণীয় সম্পর্কে একটি পরিষ্কার রোডম্যাপ প্রস্তুত করতে হবে।’
স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠায় বাধা
স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠায় বাধাগুলো তুলে ধরে প্রধান বিচারপতি বলেন, কোনো সন্দেহ নেই যে, বিদ্যমান সমস্যাগুলোর মধ্যে প্রধান সমস্যা হচ্ছে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ কার্যকররূপে পৃথক না হওয়া। এর কুফল আমরা সবাই ভোগ করেছিলাম গত দেড় দশক ধরে। এছাড়াও আছে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব, মামলা অনুপাতে বিচারকের নিদারুণ স্বল্পতা, বার ও বেঞ্চের মধ্যে সহযোগিতার মনোভাবের ঘাটতি, আদালতগুলোর অবকাঠামোগত সংকট, অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে কোনো যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য নীতিমালা না থাকা, উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগ, স্থায়ীকরণ ও উন্নীতকরণের ক্ষেত্রে কোনো আইন না থাকা ও প্রথাগত জ্যেষ্ঠতার নীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন ইত্যাদি বিষয়গুলো; যা আমাদের বার বার পিছিয়ে দিয়েছে।
স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠায় প্রধান বিচারপতির একগুচ্ছ প্রস্তাবনা
প্রধান বিচারপতি বলেন, একটি ন্যায়ভিত্তিক বিচারব্যবস্থার কাজ হলো নিরপেক্ষভাবে, স্বল্প সময় ও খরচে বিরোধের মীমাংসা নিশ্চিত করে জনগণ, সমাজ ও রাষ্ট্রকে সুরক্ষা দেওয়া। এজন্য বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ ও আইনসভা থেকে পৃথক ও স্বাধীন করা সবচেয়ে জরুরি। কেননা শাসকের আইন নয়, বরং আইনের শাসন নিশ্চিত করাই বিচার বিভাগের মূল দায়িত্ব। বিচার বিভাগ যেন স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারে তার জন্য আমি জরুরি ভিত্তিতে বিচার বিভাগে কিছু সংস্কার বাস্তবায়নের জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি এবং এ বিষয়ে সর্বোচ্চ সহযোগিতা কামনা করছি। এই সংস্কারের উদ্দেশ্য হবে বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে তা দ্রুত দূর করে একটি স্বাধীন, শক্তিশালী, আধুনিক, দক্ষ ও প্রগতিশীল বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা।
বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণের স্বার্থে মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন একান্ত আবশ্যক। বাংলাদেশের সংবিধানের ১১৬ক অনুচ্ছেদে অধস্তন আদালতের বিচারকরা বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবেন মর্মে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু বিচারকদের প্রকৃত স্বাধীনতা ততদিন পর্যন্ত নিশ্চিত হবে না; যতদিন না বিচার বিভাগে দীর্ঘদিন ধরে বিরাজমান দ্বৈতশাসন ব্যবস্থা, অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্ট ও আইন মন্ত্রণালয়ের যৌথ এখতিয়ার সম্পূর্ণরূপে বিলোপ করে জরুরি ভিত্তিতে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অধীনে পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে। এটি হবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতকল্পে প্রয়োজনীয় সংস্কারের প্রথম ধাপ। সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদে হাইকোর্ট বিভাগের অধস্তন সব আদালত ও ট্রাইব্যুনালের ওপর হাইকোর্ট বিভাগের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতা থাকবে মর্মে উল্লেখ রয়েছে। এই অনুচ্ছেদের বুনিয়াদে সংবিধানের কোনো সংশোধন না করেই শুধু রুলস অব বিজনেস এবং বিচারকদের নিয়োগ, কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি, বরখাস্তকরণ, শৃঙ্খলা বিধান ইত্যাদি সংক্রান্ত রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রণীত যেসব বিধিমালা প্রচলিত রয়েছে সেগুলোতে প্রদত্ত ‘উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ’-এর সংজ্ঞায় পরিবর্তন এনে সেখানে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় এর সচিবকে অন্তর্ভুক্ত করলেই সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় তথা বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠার পথে আইনগত কোনো বাধা থাকবে না। এছাড়াও জেলা আদালতগুলোর বাজেট বরাদ্দের বিষয়টিও তখন বিচার বিভাগীয় সচিবালয় হতেই নিশ্চিত করা হবে। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন সচিবালয় এবং জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের ন্যায়বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার জন্য পরিপূর্ণ প্রস্তাব প্রস্তুতক্রমে আমরা শিগগিরই আইন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করব। উক্ত প্রস্তাব বাস্তবায়নে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য আমি মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা এবং মঞ্চে উপবিষ্ট আইন উপদেষ্টার সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
প্রধান বিচারপতি বলেন, এই Plan of Action- এ বিচার বিভাগের স্বাধীনতার আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নিশ্চিতকরণে UN Basic Principles on the Independence of the Judiciary- তে বর্ণিত বিধানকে অনুসরণীয় Best practice guideline হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। আমি বিশ্বাস করি, বর্তমান সময়ই এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের শ্রেষ্ঠ সময়।
বিচারকদের আশ্বস্ত করে প্রধান বিচারপতির বার্তা
প্রধান বিচারপতি বলেন, বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠার পর বিচার বিভাগে গুণগত পরিবর্তন আনতে আমার অন্যতম কাজ হবে বিচারকদের যোগ্যতার ভিত্তিতে পদায়ন নিশ্চিত করা। ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের ঊর্ধ্বে উঠে কর্মরত বিচারকদের মধ্য থেকে সৎ, দক্ষ, স্বাধীন মনোভাব ও নেতৃত্বদানের গুণাবলি সম্পন্ন উপযুক্ত বিচারকদের নিয়ে প্যানেল বা ফিট লিস্ট তৈরি করে সে প্যানেল থেকে প্রতিষ্ঠান প্রধান, যেমন- জেলা জজ, দায়রা জজ, সিজেএম, সিএমএম পদে নিয়োগ প্রদানের ব্যবস্থা আমি নিশ্চিত করব, যেন বিচার বিভাগ আগের শাসনামলের ন্যায় ভিতু ও আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে না পারে। বর্তমানে বিচারকদের পদায়ন ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে কোনো ঘোষিত নীতিমালা নেই। ফলে পদায়ন ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে অনেক সময়ই বিচারকরা বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। আমি এ বিষয়ে একটি যথোপযুক্ত নীতিমালা দ্রুত প্রণয়ন করব।
উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে কলেজিয়াম ব্যবস্থা চালু
প্রধান বিচারপতি বলেন, শুধু বিচার বিভাগীয় পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করলেই হবে না, সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রেও সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন করতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্যতা হিসেবে সংবিধানের ৯৫(২) অনুচ্ছেদে যে বিধান রয়েছে কেবল সেটুকু নিশ্চিত করে বিচারক নিয়োগের ফলে সুপ্রিম কোর্টে এক অভূতপূর্ব অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অনেক ক্ষেত্রেই রাজনীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হিসেবে পালন করেছে। এটি ন্যায়বিচারের ধারণার সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। যুক্তরাজ্যের সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগের জন্য স্বাধীন Judicial Appointments Commission রয়েছে। যোগ্য ব্যক্তিদের কাছ থেকে এই কমিশন দরখাস্ত আহ্বান এবং সাক্ষাৎকার সর্বােযোগ্য ব্যক্তিকে বিচারক হিসেবে মনোনীত করে। আমাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতের সংবিধানেও উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগের কোনো সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা না থাকার প্রেক্ষিতে সে দেশের উচ্চ আদালত বিচারিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে ১৯৯৩ সাল থেকে কলেজিয়াম পদ্ধতির প্রবর্তন ঘটিয়েছে।
তাই উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে অন্যান্য দেশগুলোতে অনুসৃত আধুনিক পদ্ধতিগুলো বিবেচনায় নিয়ে আমাদের দেশে উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে একটি কলেজিয়াম ব্যবস্থা চালু করতে আমি সচেষ্ট হব। আমি আশাবাদ ব্যক্ত করি যে, এই প্রচেষ্টায় আমি আপনাদের সবাইকে আমার পাশে পাব।
স্বাধীন বিচার বিভাগের জন্য বাজেট বাড়াতে হবে
প্রধান বিচারপতি বলেন, স্বাধীন বিচার বিভাগের অন্যতম শর্ত হচ্ছে বিচার বিভাগের আর্থিক স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ। এ উদ্দেশ্যে সুপ্রিম কোর্টের অধীনে জেলা আদালতগুলোর জন্য সরকারকে স্বতন্ত্র বাজেট বরাদ্দ করতে হবে। সুপ্রিম কোর্ট বিচার বিভাগের উন্নয়ন ও পরিচালন বাবদ যে বাজেট চাইবে সরকারকে তা প্রদান করতে হবে। মাসদার হোসেন মামলায় প্রদত্ত ১২ দফা নির্দেশনার মধ্যে ৬ নং দফায় জুডিসিয়াল পে কমিশন প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। সেই নির্দেশনার আলোকে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস (পে কমিশন) বিধিমালা ২০০৭ প্রণীত হয়েছে। উক্ত বিধিমালার ৪ (৩) বিধিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে পে কমিশন প্রতি পাঁচ বছর অন্তর দেশের সামগ্রিক আর্থ সামাজিক অবস্থা এবং অন্য সার্ভিসের বেতন কাঠামোর সাথে সামঞ্জস্য রেখে সার্ভিসের সদস্যদের বেতন ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ- সুবিধাদি পর্যালোচনাপূর্বক সুপারিশ প্রণয়ন এবং তা সরকারের নিকট পেশ করবে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে মাসদার হোসেন মামলার নির্দেশনার আলোকে এ পর্যন্ত মাত্র দু’বার জুডিসিয়াল সার্ভিস পে কমিশন গঠিত হয়েছিল। আরো দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, উভয় পে কমিশনের প্রতিবেদনে মাসদার হোসেন মামলার ৬ নম্বর নির্দেশনায় কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অথচ এরপরেও কমিশনের সুপারিশ সরকার পুরোপুরিভাবে বাস্তবায়ন করেনি। যেমন- দ্বিতীয় পে কমিশনের প্রতিবেদনের ৭.১ অনুচ্ছেদে জুডিসিয়াল সার্ভিসের সব পর্যায়ের সদস্যদের মাসিক মূল বেতনের ৩০% সমপরিমাণ হারে জুডিসিয়াল ভাতা প্রদান করার সুপারিশ করা হয়েছিল। ২০১৬ সালের বেতন ভাতাদি আদেশে সরকার ৩০% জুডিসিয়াল ভাতার বিধান রেখেছে, তবে সেটা ২০০৯ সালের স্কেলের ওপর, যা পে কমিশনের সুপারিশের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। বিচার বিভাগের অর্থপূর্ণ স্বাধীনতার জন্য আদালত ও বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং সহায়ক কর্মকর্তা ও কর্মচারির পদ সৃজনে সুপ্রিম কোর্টের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা থাকা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এক্ষেত্রে সরকার তথা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সম্পৃক্ততা যৌক্তিক কারণেই থাকবে, তবে তারা কেউ পদসৃজনে অযৌক্তিক আপত্তি প্রদান করতে পারবে না।
এ বিষয়ে উল্লেখ্য যে, ইতঃপূর্বে আইন মন্ত্রণালয় থেকে বিচারকের পদ সৃষ্টির প্রস্তাব জনপ্রশাসন ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হলেও উক্ত মন্ত্রণালয়গুলো বিভিন্নভাবে আদালত ও পদ সৃষ্টির কাজে অযৌক্তিক বাধা দিয়েছে। এই সংস্কৃতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। অন্যদিকে, আদালতের সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বজায় রাখার জন্য জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে যেন তাদের নিয়োগ প্রদান করা যায় সেজন্য প্রচলিত আইন ও বিধি সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করা আবশ্যক। তাদের ব্লক পদ বিলুপ্ত করে যুগোপযোগী পদ সৃজনপূর্বক যোগ্যতা ও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে পদোন্নতির সুযোগ রেখে অভিন্ন নিয়োগ বিধি প্রণয়ন করতে হবে। এ বিষয়ে আইন উপদেষ্টা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন মর্মে আমি আশাবাদী।
বিচারকদের অবকাঠামোগত সুবিধা বৃদ্ধির তাগিদ
প্রধান বিচারপতি বলেন, বিচারকরা যে গুরু দায়িত্ব পালন করেন তা রাষ্ট্র কাঠামোর ভিত্তি মজবুত করতে সহায়তা করে। আমাদের বুঝতে হবে যে একজন সহকারী জজের আদেশও প্রজাতন্ত্রের সব পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী মানতে বাধ্য, কেননা বিচারকরা রাষ্ট্রের সার্বভৌম বিচারিক ক্ষমতার প্রয়োগ করে থাকেন। মাসদার হোসেন মামলার রায়ে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি, বিচারপতি মোস্তফা কামাল আমাদের দেশের অধস্তন আদালতের বিচারকদের মর্যাদা ও তাদের পেশাগত অবস্থান স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন। সব বিচারকদের জন্য পৃথক গাড়ি নেই। উপজেলা পর্যায়ে অবস্থিত চৌকি আদালতের বিচারকদের অবস্থা আরো শোচনীয়। তাদের সরকারি বাহন, বাসস্থান, নিরাপত্তা-কোনোটিই নেই। মাঠ পর্যায়ে বিচার বিভাগের কার্যকর পৃথকীকরণ নিশ্চিতকল্পে বিচারকদের পৃথক আবাসন, পরিবহন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি এবং আমি এই বিষয়টি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দ্রুত সমাধান করার জন্য আইন উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
বর্তমানে অনেক জেলায় বিচারকদের চেম্বার ও এজলাস শেয়ার করতে হয়। ফলে বিচারিক কর্ম ঘণ্টার পূর্ণ ব্যবহার করতে না পারায় নিষ্পত্তি সংখ্যা কমে যায়। তাই বিচারকদের বিদ্যমান এজলাস ও চেম্বার সংকট নিরসনে যেসব জেলায় এখনও সিজেএম বিল্ডিং নির্মাণ করা হয়নি, সেসব জেলায় দ্রুত কাজ শেষ করার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ প্রদান, মেট্রোপলিটন এলাকায় পৃথক সিএমএম ও মহানগর দায়রা জজ আদালত ভবন নির্মাণ এবং উপজেলা পর্যায়ে চৌকি আদালতের ভবন নির্মাণ ও সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়ার জন্য আমি সরকারের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি।
মামলাজট নিরসনে জনসংখ্যা ও মামলার সংখ্যা অনুপাতে বিচারক নিয়োগ দিতে হবে
প্রধান বিচারপতি বলেন, মামলাজট বিচার বিভাগের একটি বড় সমস্যা হিসেবে সব আমলেই চিহ্নিত হয়ে এসেছে। বর্তমানে সারাদেশে প্রায় ৪২ লাখ মামলা বিচার নিষ্পত্তির জন্য অপেক্ষমাণ আছে। মামলাজট নিয়ে সুধীমহলে অনেক ক্ষোভ রয়েছে। কিন্তু এটি মুদ্রার একটি পিঠ। মুদ্রার অন্য পিঠটা কখনো খুব বেশি আলোচনায় আসে না। মুদ্রার অন্য পিঠে আছে স্বল্প সংখ্যক লোকবল, এজলাস সংকট তথা অবকাঠামোগত অসুবিধাসহ বিভিন্ন প্রতিকূলতা। কিন্তু এর মধ্যেও মাত্র ২০০০ বিচারকের মাধ্যমে এক বছরে গড়ে ১০ (দশ) লাখের বেশি মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে। এই সংখ্যা প্রমাণ করে মামলাজটের কারণ বিচার বিভাগ বা বিচারকরা নন। বরং মামলা জটের অন্যতম কারণ হচ্ছে মামলার তুলনায় বিচারকের সংখ্যার অপ্রতুলতা। বর্তমান বাস্তবতায় বিচার বিভাগকে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হলে সমগ্র বিচার বিভাগের সাংগঠনিক কাঠামো বা অর্গানোগ্রাম সংস্কার করে দেশের জনসংখ্যা ও মামলার সংখ্যা অনুপাতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিচারক নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। এছাড়া, বর্তমানে যে প্র্যাকটিস রয়েছে যে একজন বিচারক একই সঙ্গে একাধিক কোর্ট এবং ট্রাইব্যুনালের দায়িত্বে থাকেন, তা বিলোপ করে একজন বিচারককে একটি কোর্টের দায়িত্ব প্রদান করতে হবে। এজন্য আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধন আনতে হবে। এছাড়া, দেওয়ানি ও ফৌজদারি এখতিয়ার অনুসারে পৃথক আদালত স্থাপন করা প্রয়োজন। যুগ্ম জেলা জজ থেকে জেলা জজ পর্যন্ত আদালতে এই সংস্কার আনতে হবে। এসব কিছুর জন্য সিভিল কোর্টস অ্যাক্ট- এ পরিবর্তন আনতে হবে। সংস্কার প্রক্রিয়ার শুরুতে এখন অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমেও এটা সম্ভব।এসব সংস্কারের পাশাপাশি সহকারী জজ ও সিনিয়র সহকারী জজদের জন্য দ্রুত স্টেনো টাইপিস্ট/স্টেনোগ্রাফার পদে দক্ষ জনবল নিয়োগ এবং যেসব যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ কোর্টে স্টাফ/স্টেনো টাইপিস্ট/স্টেনোগ্রাফার নেই, সেসব কোর্টে দ্রুত জনবল নিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের নিমিত্ত আমি মাননীয় উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
আইনজীবীদের পেশাগত দক্ষতা বাড়ানোর তাগিদ
প্রধান বিচারপতি বলেন, মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রিতা বিচারপ্রার্থীদের দীর্ঘশ্বাসের কারণ। বিচার ব্যবস্থাকে এমনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে যেন বিচারপ্রার্থীদের সময় ও খরচ উল্লেখযোগ্য হারে কমে এবং আদালত প্রাঙ্গণে তাদের বার বার না আসতে হয়। তবে এই বিষয়টি বিচারকের একার ওপর নির্ভর করে না। এজন্য বারের সহযোগিতা একান্ত কাম্য। আইনজীবীদের পেশাগত দক্ষতা বাড়াতে হবে। একটি সমৃদ্ধ বার সমৃদ্ধ বিচার ব্যবস্থা তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। এখানে বার কাউন্সিলের সম্মানিত চেয়ারম্যান বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল উপস্থিত আছেন। আমি এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের আকর্ষণ করছি।
Discussion about this post