ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকায় আওয়ামী লীগের আমলে সরকারদলীয় কাউন্সিলর ও নেতাদের কবজায় ছিল ময়লা বাণিজ্য। বিভিন্ন বাসাবাড়ি, দোকান, রেস্তোরাঁসহ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে মাসিকভিত্তিতে নির্দিষ্ট টাকার বিনিময়ে বর্জ্য সংগ্রহের পিসিএসপি নিবন্ধন ছিল কিছু ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের নামে। তবে তারা ছিল মূলত কাউন্সিলরদের ঘনিষ্ঠ। তাদের দিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করলেও নির্দিষ্ট ভাতা ছাড়া বর্জ্য বাণিজ্যের লাভের গুড় যেত কাউন্সিলরদেরই পকেটে। সরকার পতনের পর ময়লার ব্যবসার নিয়ন্ত্রকও পরিবর্তন হয়েছে। ময়লার ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতে উঠে পড়ে লেগেছেন বিএনপি নেতারা।
জানা গেছে, ডিএসসিসিতে সম্প্রতি লটারির মাধ্যমে ৫১টি ওয়ার্ডের বর্জ্য সংগ্রহের নিবন্ধন পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশই বিএনপি নেতাদের। বৃহস্পতিবার বাকি ২৪টি ওয়ার্ডের বর্জ্য সংগ্রহের নিবন্ধন দিতে করপোরেশনে লটারির আয়োজন করা হয়। কিন্তু বিএনপি নেতাদের বাধায় ১৩টি ওয়ার্ডে লটারি করতে পারেনি করপোরেশন। একটি ওয়ার্ডে লটারির মাধ্যমে এক পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী নিবন্ধন পেলেও বিএনপি নেতাদের বাধায় শেষ পর্যন্ত কাজ করবেন না বলে করপোরেশনে লিখিত দিতে বাধ্য হন তিনি।
ডিএসসিসি সূত্র জানায়, গত ৩১ জুলাই ছিল ২০২৩-২৪ অর্থবছরের পিসিএসপি নিবন্ধনের শেষ সময়। এর আগে ডিএসসিসির নতুন নিবন্ধনের আবেদন জমা পড়লেও অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে সেটি বাতিল করে গত ১৫ আগস্ট আবার বিজ্ঞপ্তি দেয়। ৫ সেপ্টেম্বর করপোরেশনে লটারির মাধ্যমে ৫১টি ওয়ার্ডে পিসিএসপি নিবন্ধন চূড়ান্ত হয়। বাকি ২৪টি ওয়ার্ডে একটি করে আবেদন পড়লে আবার বিজ্ঞপ্তি দেয় করপোরেশন। এ বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার আগের ২৪টি ওয়ার্ডের বিপরীতে ১৯টি এবং পরবর্তী সময়ে ৮০টিসহ মোট ৯৯টি আবেদনপত্র দাখিল করা হয়। এর মধ্যে ৬৯, ৭০ ও ৭৫ নম্বর ওয়ার্ডে কোনো আবেদনপত্র জমা পড়েনি। ফলে এ তিনটি ওয়ার্ডে পুনরায় দরপত্র আহ্বানের সিদ্ধান্ত হয়। আর ৭৩ নম্বর ওয়ার্ডে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত করা হয় আগের আবেদনকৃত প্রতিষ্ঠানকে। বাকি ২০টি ওয়ার্ডে দাখিলকৃত আবেদনকারীদের সক্ষমতা সরেজমিন যাচাই-বাছাই শেষে গতকাল লটারির মাধ্যমে নিবন্ধনের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু তাতে বাগড়া দেন বিভিন্ন ওয়ার্ডের বিএনপি নেতারা। যাচাই-বাছাইয়ে নিজস্ব ভ্যান, পূর্বের ময়লা সংগ্রহের অভিজ্ঞতাসহ নানা শর্তে বাদ দেওয়া প্রতিষ্ঠানকে পিসিএসপি নিবন্ধনের জন্য রাখতে বর্জ্য কর্মকর্তাকে তাঁর কক্ষে অবরুদ্ধ করে রাখেন বিএনপি নেতারা। বাধ্য হয়ে ১, ২, ৪, ১৪, ২১, ২২ এবং ৩০ নম্বর ওয়ার্ড ছাড়া বাকি ১৩টি ওয়ার্ডে আর লটারি করতে পারেনি করপোরেশন।
অভিযোগ আছে, সূত্রাপুর থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক আহ্বায়ক মেহেদী হাসান লিটু, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের নেতা সৈয়দ মুকিতুল হাসান রঞ্জু, সাবেক ছাত্রদল নেতা ও ডিএসসিসির এক প্রকৌশলী বর্জ্য কর্মকর্তাদের যোগসাজশে পিসিএসপি নিবন্ধনে আবেদনকারীদের বাদ দেওয়া হয়েছে। এমনকি ১ নম্বর ওয়ার্ডে ‘মেসার্স সাগর এন্টারপ্রাইজ’ নামে এক পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী সিমা আক্তারের প্রতিষ্ঠান লটারির মাধ্যমে পিসিএসপি নিবন্ধনের সুযোগ পেলেও বিএনপি নেতাদের বিরোধিতায় তিনি কাজ করবেন না বলে করপোরেশনে লিখিত দিয়ে যান। এ দিন করপোরেশনে যুবদল নেতা সৈয়দ মুকিতুল হাসান রঞ্জু দুই শতাধিক অনুসারী নিয়ে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি করেন।
করপোরেশন সূত্রে ও সমকালের অনুসন্ধানে কয়েকটি ওয়ার্ডে পিসিএসপি নিবন্ধনের প্রতিষ্ঠানে দেখা গেছে, ডিএসসিসি এলাকার ৫৪ নম্বর ওয়ার্ডে বাসাবাড়ির বর্জ্য সংগ্রহ করছে মেসার্স শাহাদাত স্টিল, যার মালিক শুভ শিকদার। তিনি ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক। ৪৫ নম্বর ওয়ার্ডের ময়লার ঠিকাদারি পেয়েছে মারিয়াম এন্টারপ্রাইজ। এটির মালিক আহসান ফরিদী, গেণ্ডারিয়া থানা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক। ৬৮ নম্বর ওয়ার্ডের ইজারা পাওয়া প্রতিষ্ঠান সোহেল এন্টারপ্রাইজের মালিক নুরুজ্জামান বাবু ওয়ার্ড বিএনপির সহসভাপতি। ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ইজারা পেয়েছে সৃজন এন্টারপ্রাইজ। প্রতিষ্ঠানটির মালিক শাহজাহান পামের ৭ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি নেতা। ৬৪ নম্বর ওয়ার্ডে ইজারা পেয়েছে আলম অ্যান্ড কোং। প্রতিষ্ঠানটির মালিক শাহ আলম হলেও ঠিকাদারি কাজটি পেয়েছেন ওয়ার্ড যুবদলের সম্পাদক মোহাম্মদ আলী। ৪৯ নম্বর ওয়ার্ডে ময়লার ঠিকাদারি পেয়েছে স্বাধীন এন্টারপ্রাইজ। প্রতিষ্ঠানটির মালিক ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি মোছলেহ উদ্দীন। ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে ইজারা পেয়েছে এসএএস এন্টারপ্রাইজ। প্রতিষ্ঠানটির মালিক স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি সফিউদ্দিন আহমেদ সেন্টু। তবে এসব নেতার দাবি, তারা ১৭ বছর করপোরেশনে কাজ করতে পারেননি। তাই তারা নিয়ম মেনেই নিবন্ধন করেছেন।
ডিএসসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা আবু তাহের বলেন, লটারির মাধ্যমে পিসিএসপি নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে। এখানে কোনো অনিয়ম ঘটেনি।
Discussion about this post