১৯৮৩ সালে জনতা ব্যাংকে চাকরি শুরু করেন আব্দুস ছালাম আজাদ। এরপর তিনি যত শাখায় কাজ করেছেন, সবখানেই বেশুমার দুর্নীতি করে নিজে লাভবান হয়েছেন এবং ব্যাংকের মারাত্মক ক্ষতি করেছেন। নিজের অপকর্ম ঢাকতে অধীন কর্মকর্তাদের ছোট-বড় শাস্তির মুখে ফেলেছেন। জেলও খাটিয়েছেন। তাদের মধ্যে ডিএমডি, ডিজিএম, এজিএম, এসপিও পদমর্যাদার কর্মকর্তারাও রয়েছেন। নিরাপদে থেকে বিভিন্ন গ্রাহকের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। সেই টাকা পাচার করে দুবাইয়ে বাড়ি বানিয়েছেন। বিপরীতে ডুবিয়েছেন জনতা ব্যাংককে। সর্বশেষ ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) দায়িত্বে থেকে সাড়ে ৫ বছরে দ্বিগুণ করেছেন খেলাপি ঋণ। এর বেশিরভাগই পুঞ্জীভূত হয়েছে বড় গ্রাহকদের কাছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক, দুদকসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন প্রতিবেদন পর্যালোচনায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১৭ সালের ৫ ডিসেম্বর প্রধান নির্বাহী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন আব্দুস ছালাম আজাদ। ওই সময় জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৭ হাজার ৫৯৯ কোটি টাকা। এমডি হিসেবে তিনি দায়িত্ব শেষ করেন ২০২৩ সালের এপ্রিলে। ওই সময় ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৪ হাজার ৮৮৭ কোটি টাকা। আর বর্তমানে ব্যাংকটির খেলাপি দাঁড়িয়েছে ৪৮ হাজার কোটি টাকা।
তথ্য বলছে, এমডি থাকা অবস্থায় আব্দুস ছালাম আজাদ জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের তথ্য লুকিয়েছেন। যে ধারা অব্যাহত রেখেছেন পরবর্তী এমডি জব্বারও। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন গভর্নর খেলাপি ঋণের প্রকৃত তথ্য বের করে আনায় তা ৪৮ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
জানা গেছে, ছালাম আজাদ এমডির দায়িত্ব নেওয়ার সময় ব্যাংকটির শীর্ষ গ্রাহক ছিল ১১টি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের কাছে মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ১৩ হাজার ৪৭৮ কোটি টাকা। কিন্তু তিনি দায়িত্ব ছেড়ে যাওয়ার সময় এই গ্রাহকের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩-এ। আর এদের মধ্যে সম্মিলিত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৯ হাজার ৫৮৪ কোটি টাকা। এ ছাড়া জনতা ব্যাংক থেকে বিতর্কিত ব্যবসায়ী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানকে বিশেষ বিবেচনায় ২৩ হাজার কোটি টাকার ঋণও দিয়েছেন এই আব্দুস ছালাম আজাদ। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২২ সালের এক প্রতিবেদনে জনতা ব্যাংক থেকে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম ও তার পরিবারের চার সদস্য, এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার ও তার স্ত্রী, আইএফআইসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান এবং এসবিএসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবদুল কাদির মোল্লা বিপুল অর্থ নামে-বেনামে বের করে নিয়েছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছিল। পরে অদৃশ্য কারণে সেই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে জনতা ব্যাংক ও আব্দুস ছালাম আজাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এদিকে জনতা ব্যাংকে থাকা অবস্থায় অবৈধ সম্পদ অর্জনের দায়ে আব্দুস ছালাম আজাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকে জমা হওয়া অভিযোগে তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঋণ বিতরণে জালিয়াতি, ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ বিতরণ, অর্থ পাচার, প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন তদন্তে নাম বাদ রাখা, ক্ষমতার অপব্যবহার করে সহযোগীদের বিপুল সম্পদের মালিক বানানোসহ বেশ কয়েকটি অভিযোগ আনা হয়েছে।
দুবাইয়ে ২০০ কোটি টাকার ডুপ্লেক্স বাড়ি:
দুদকের অভিযোগপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে ২০০ কোটি টাকা দামের একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি ‘ঘুষ’ হিসেবে নিয়েছেন জনতা ব্যাংকের সাবেক এমডি আব্দুস ছালাম আজাদ। অনিয়মের মাধ্যমে ঋণ অনুমোদনের জন্য ব্যাংকের গ্রাহক বিসমিল্লাহ গ্রুপের খাজা সোলাইমান এই বাড়ি দেন তাকে। দুই দফায় এমডি ও সিইও করার জন্য বিসমিল্লাহ গ্রুপ তার পেছনে ১৪ কোটি টাকা ব্যয় করে বলেও অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে।
এমডির প্রভাবে জনতা ব্যাংকের সব রকম ইন্স্যুরেন্স ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্সকে দেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। ওই প্রতিষ্ঠানের ডিএমডি নাজির উদ্দিন আহমেদের কাছ থেকে অবৈধ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নেন আব্দুস ছালাম। তার সহযোগিতায় প্রধান কার্যালয় শাখার জিএম আব্দুল ওয়াদুদ ও ডিজিএম লিটন রায় চৌধুরী সস্ত্রীক সিঙ্গাপুর ও দুবাই সফর করে সেখানে এমডি ছালাম আজাদের অর্থ পাচারে সহযোগিতা করেন।
অভিযোগে আরও বলা হয়, ব্যাংকের প্রয়োজনের সময় বদলি, প্রাইস পোস্টিংসহ ক্ষমতার অপব্যবহার করে অধীনদের কাছ থেকে বিপুল অর্থ আদায় করেন ছালাম আজাদ। ক্রেডিট কমিটিতে প্রকল্প পাস, সুদ মওকুফের নামে অবৈধভাবে মোটা অঙ্কের ঘুষ নেন তিনি। এ ছাড়া শৃঙ্খলা কমিটিতে দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের শাস্তি লাঘবের নামে সহযোগীদের মাধ্যমে বিপুল টাকা হাতিয়ে নেন।
ঢাকায় নয়, আয়কর রিটার্ন দেন সিরাজগঞ্জে:
তথ্যমতে, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ৩ থেকে ৪ হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন আব্দুস ছালাম আজাদ। দুর্নীতির মাধ্যমে আয় করা অর্থ বিদেশে অবস্থানরত ছেলেমেয়েদের কাছে পাচার করেছেন। তার আয়কর নথি ঢাকার কর অঞ্চল-১৫-এ থাকার কথা। কিন্তু জ্ঞাত-আয়বহির্ভূত সম্পদ লুকানোর জন্য তিনি সিরাজগঞ্জে আয়কর রিটার্ন দাখিল করেন।
ছালাম আজাদ তার একনিষ্ঠ অনুসারী ডিজিএম ইসমাইলকে (বর্তমানে প্রয়াত) এফটিডি পরিদর্শন বিভাগের প্রধান করে সেখান থেকে বিভিন্ন নথিপত্র গায়েব করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ মঞ্জুরিতে অনিয়মসহ বিভিন্ন জালিয়াতির প্রমাণ নষ্ট করে ফেলেছেন।
অ্যাননটেক্সের ঋণে অনিয়ম:
২০২০ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিদর্শনে জনতা ব্যাংকের বহুল সমালোচিত অ্যাননটেক্স গ্রুপের ৫ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় এমডি মো. আব্দুস ছালাম আজাদের সম্পৃক্ততা পায়। আইনকানুন ও নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে গ্রুপটির ঋণের অনুমোদন, বিতরণ এবং পরিবীক্ষণে সহায়তা করেছেন তিনি। তার প্রত্যক্ষ সহায়তায়ই এলসি (ঋণপত্র) জালিয়াতির মাধ্যমে আমদানির নামে প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা বের করে নেওয়া হয়েছে। এ ঘটনার প্রমাণ পাওয়ায় তাকে অপসারণের সুপারিশ করে পরিদর্শক দল। কিন্তু অদৃশ্য কারণে ওই সুপারিশ আর বাস্তবায়ন হয়নি।
পরিদর্শন রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, ২০০৭ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত জনতা ব্যাংকে অ্যাননটেক্সের ২২টি প্রতিষ্ঠানের নামে চলতি হিসাব খোলা হয়। এর মধ্যে করপোরেট শাখায় ২০টি এবং লোকাল অফিসে দুটি। সেসব অ্যাকাউন্টে ২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গ্রুপটির ঋণের স্থিতি ছিল ৫ হাজার ৭৬৮ কোটি ৫২ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে হিসাব খোলা থেকে শুরু করে ঋণ অনুমোদন, বিতরণ, পরিবীক্ষণ এবং বারবার পুনঃতপশিলে অনেক গুরুতর অনিয়ম এবং জালিয়াতি হয়েছে।
তড়িঘড়ি করে হিসাব খুলে উল্লিখিত প্রতিষ্ঠানগুলোর নামে ব্যাংক কর্তৃক প্রয়োজনীয় যাচাই-বাছাই ছাড়াই ঋণ অনুমোদনের পর মঞ্জুরির শর্ত পরিপালন না করে টাকা বিতরণ করা হয়েছে। কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে এসব কাজ করেছেন ব্যাংকের তৎকালীন ব্যবস্থাপক শাখা ম্যানেজার মো. আব্দুস ছালাম আজাদ। যিনি পরে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হয়েছেন।
১৫টি প্রকল্প দেখিয়ে ঋণ নেওয়া হলেও ৯টি প্রকল্প স্থাপনই হয়নি। ফলে ব্যাংক থেকে প্রকল্প সম্পাদন প্রতিবেদন ইস্যু করেনি। এক্ষেত্রে সাজানো দরপত্র আহ্বান দেখিয়ে অ্যাননটেক্স গ্রুপের প্রস্তাবিত বিভিন্ন প্রকল্প স্থাপনের জন্য বিদেশি মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির অর্থ নিজেদের ইনভেনটর প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে বের করে নেওয়া হয়েছে। এর বড় অংশই পাচার করা হয়েছে।
এসব ঋণ নেওয়া ও টাকা পাচারে সরাসরি সহায়তা করেছেন ব্যাংকের তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক মো. আব্দুস ছালাম আজাদ। অনেক ক্ষেত্রে এক প্রতিষ্ঠানের নতুন ঋণের অর্থ অন্য প্রতিষ্ঠানের নামে আংশিক পরিশোধ করে খেলাপি না দেখিয়ে ঋণ নিয়মিত দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এসব ঋণের প্রায় পুরোটাই বর্তমানে কুঋণে রূপ নিয়েছে।
ঋণ-সংক্রান্ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ নথি, কিছু প্রতিষ্ঠানের হিসাবের নমুনা স্বাক্ষর কার্ড পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া শাখা ব্যবস্থাপক থাকা অবস্থায় দেওয়া ঋণ বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে তথ্য গোপন করে এমডির পদে থেকে পুনঃতপশিল করেছেন আব্দুস ছালাম আজাদ, যা নিয়ে অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
দুদকে জমা হওয়া অভিযোগে বলা হয়, জনতা ব্যাংক একসময় ছিল সরকারি খাতের সেরা ব্যাংক। ভালো শিল্পোদ্যোক্তা ও বড় ব্যবসায়ীরা ছিলেন এ প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক। অথচ এখন এ ব্যাংকের বড় গ্রাহকদের মধ্যে রয়েছে দেশের অন্যতম শীর্ষ ঋণখেলাপি অ্যাননটেক্স ও ক্রিসেন্ট গ্রুপ এবং প্রভাবশালী বেশকিছু ঋণখেলাপি ব্যবসায়ী। শাখা ব্যবস্থাপক হিসেবে ব্যাংকিং নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে অ্যাননটেক্সকে বড় অঙ্কের ঋণ দিয়েছিলেন তিনি। ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ বিতরণের বিষয়ে আব্দুস ছালাম আজাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম খুঁজে পেলেও নানামুখী প্রভাবের কারণে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। তার মেয়াদ একদফা বাড়িয়ে ৬৫ বছর পর্যন্ত এমডি পদে থাকার সুযোগ করে দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।
অভিযোগের তথ্যমতে, জনতা ব্যাংকের কামাল আতাতুর্ক শাখা ছিল এজিএম শাখা। আব্দুস ছালামের পরিচিতি ছিল ওই সময়কার এমডি আমিনুর রহমানের ডানহাত হিসেবে। শাখাটিকে ডিজিএম শাখায় উন্নীত করে তিনি ডিজিএম হিসেবে পদোন্নতি নিয়ে ওই শাখার প্রধানের দায়িত্ব নেন। একইভাবে পরবর্তী সময়ে জনতা ব্যাংক ভবন শাখাকেও জিএম শাখায় উন্নীত করার পর তিনি জিএম পদোন্নতি নিয়ে ওই শাখায় বসেন। অনেক সিনিয়র ডিজিএম এবং জিএম থাকার পরও আব্দুস ছালাম তখনকার এমডি আমিনুর রহমানকে তোষণ করে সর্বকনিষ্ঠ হওয়ার পরও এই শাখায় প্রথম জিএম হিসেবে যোগ দেন।
এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য জনতা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুস ছালাম আজাদকে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে হোয়াটসঅ্যাপে প্রশ্ন পাঠানো হলেও তিনি কোনো উত্তর দেননি।
Discussion about this post