রোমের এক শীতল সকাল। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি–ফিউমিচিনো বিমানবন্দরের কার্গো গেটের সামনে কয়েকজন বাংলাদেশি দাঁড়িয়ে আছেন জড়ো হয়ে। মুখে কোনো শব্দ নেই। কারো হাতে ছোট্ট ফুলের মালা। চোখেমুখে ক্লান্তি, কেউ কাগজে মোড়া একটি ছোট্ট ব্যাগ আঁকড়ে ধরে আছেন- মৃত স্বজনের কিছু কাপড়চোপড়।সাদা জিঙ্কের কফিনটি ধীরে ধীরে ঢুকে গেল কার্গো উড়োজাহাজে। তার ভেতর একজন মানুষের জীবন, যার শুরু ছিল এক অভিবাসী স্বপ্ন দিয়ে, শেষ হলো অচেনা মাটিতে।
এই দৃশ্য এখন প্রায় নিয়মিত হয়ে উঠেছে ইতালির প্রবাসী বাংলাদেশিদের জীবনে। গত দুই মাসে এমন আরও কফিন পাড়ি দিয়েছে এই বিমানবন্দর দিয়ে, বাংলাদেশের পথে। সড়ক দুর্ঘটনা, অবৈধভাবে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়া কিংবা সহিংস ঘটনার পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটেছে হৃদরোগেপ্রবাসীদের ভাষায়, “অতিরিক্ত কাজ, অনিয়মিত জীবন আর ভয়; এই তিন জিনিসই সবচেয়ে বেশি মারে।” রোম, নাপোলি, বলোনিয়া, পেরুজিয়া, পিসা ও মনফালকোনে, প্রায় প্রতিটি শহরেই শোকের সংবাদ এসেছে। কেউ ঘুমের মধ্যে মারা গেছেন, কেউ আবার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায়।নাপোলির সান জুসেপ্পে এলাকায় থাকতেন কুমিল্লার আব্দুল কাশেম মিয়া। পরিবারে টাকা পাঠাতে দিনে দুই পালা কাজ করতেন। এক রাতে বাসার ভেতরেই বুক ধড়ফড় করে পড়ে যান। স্থানীয় চিকিৎসক জানান, ‘কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট’।
ইতালির আরেক শহর বলোনিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় ঢাকার ছেলে মো. ফারুক আহমেদের। ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে অবৈধভাবে ইতালিতে প্রবেশের সময় উপকূলীয় শহর লামপেদুসায় ২৯ বছর বয়সী নবীন হোসাইন নামে আরও এক বাংলাদেশির মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়।রাজধানী রোমের তিবুরতিনা এলাকার ব্যবসায়ী মো. জুয়েল স্থানীয় একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। পরদিন সড়ক দুর্ঘটনায় মাদারীপুরের সাইফুদ্দিন বেপারী ও কাজল নামে আরো দুই বাংলাদেশির মৃত্যু হয়।নাপোলির উমবেরতো প্রিমো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ফেনীর দাগনভূঞা থানার বাসিন্দা হারুন মাঝি। এছাড়া হৃদরোগে মারা যান রায়হান মাঝি। তিনি থাকতেন ইতালির মনফালকোনে শহরে, দেশের বাড়ি শরীয়তপুরের নড়িয়া থানার প্রেমতলা গ্রামে।
একইভাবে ফরিদপুরের মন্টু মিয়া, সজিব মুন্সী, নয়ন হাওলাদার, সালেহ আহমেদ, আব্দুল দাইয়ান, সুজন বেপারী ও ফেনির জাকির হোসেন চৌধুরী; সবাই মারা গেছেন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে।পেরুজিয়াতে ঘটেছে সহিংস ঘটনা। সেখানে মাদারীপুরের রাজৈরের যুবক সাগর বালা অভির (২১) লাশ পুলিশ উদ্ধার করে একটি বস্তার ভেতর থেকে। তদন্তে জানা যায়, মাত্র একশ ইউরোর জন্য এক ইউক্রেনীয় নাগরিক তাকে হত্যা করেছে।রোমে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব আসিফ আনাম সিদ্দিকী জানান, সেপ্টেম্বরে ৬ জন এবং অক্টোবরের প্রথম দুই সপ্তাহে আরও ৮ জনের লাশ দেশে পাঠানো হয়েছে। দুটি এখনো প্রক্রিয়াধীন।
তিনি বলেন, “আরো কয়েকজনের নাম ও ঠিকানা পাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে এদের মধ্যে কয়েকজনের লাশ ইতোমধ্যে দেশে পাঠানো হয়েছে, কয়েকজনেরটা এখনো দেশে পাঠানোর প্রক্রিয়াধীন।”
মিলানের কনসাল জেনারেল রফিকুল আলম বলেন, “এই দুই মাসে আমরা ৭টি লাশ দেশে পাঠিয়েছি। আরও কয়েকজনের প্রক্রিয়া চলছে।”