রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের দুঃসময়ে সরকারিভাবে আইনি সহায়তা প্রদান ও অর্থ বরাদ্দের বিষয়টি নিয়ে কয়েকদিন ধরেই কাজ করছি। নতুন বাজেটকে কেন্দ্র করে সমকাল-এ ‘পেনশন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বরাদ্দ চান প্রবাসীরা’ এই শিরোনামে একটি রিপোর্টও প্রকাশ হয় আমার। যেখানে প্রবাসে চাকরিচ্যুত কর্মী, আহত কর্মীদের আইনি সহায়তা দেওয়ার লক্ষ্যে বাজেটে বরাদ্দ রাখার দাবিটি স্পষ্টভাবে উঠে আসে। তাই বিষয়টি নিয়ে আরও গভীরে যেতে ইচ্ছে হলো। আইনি সহায়তা সংশ্লিষ্ট এরূপ কয়েকজন প্রবাসীকে নিয়ে এর আগেও আমার লেখার অভিজ্ঞতা রয়েছে। কৌতুহল বশতঃ পূর্বে সেই প্রতিবেদনগুলো খুঁজতে গিয়ে চোখে পড়ে হারুনের খবরটি। সংযুক্ত আরব আমিরাতের বাংলাদেশ কমিউনিটির কাছে নিশ্চয়ই আবুধাবি প্রবাসী হারুন অত্যন্ত পরিচিত মুখ। কারণ, বিভিন্নভাবে তাকে নিয়ে গণমাধ্যমে লেখালেখি হয় সেসময়।
একটু পেছনে ফিরে তাকাই, ২০১৫ সালের ১৪ নভেম্বর এমিরেটস এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে পরিবার-পরিজনের কাছে ফিরে যান সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রবাসী হারুন তালুকদার। তারও পূর্বে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কর্মস্থলে দুর্ঘটনাকবলিত হয়ে স্থায়ীভাবে পঙ্গুত্ব বরণ করেন এই প্রবাসী। ব্যয়বহুল চিকিৎসা খরচ জোগাতে অক্ষম হওয়ায় হাসপাতালেও থাকতে পারেননি বেশিদিন। পঙ্গু হারুনের স্থান হয়েছিল একটি বদ্ধ ঘরের বিছানায়। শয্যাশায়ী হারুনকে মালিকপক্ষ সম্পূর্ণ অমানবেতর পরিবেশে পরিত্যক্ত অবস্থায় ফেলে রাখে। অবহেলা, অসহায়ত্ব ও একাকীত্ব তাকে একটি বিষাদময় জীবনের দিকে ঠেলে দেয়। অথচ সে স্বপ্নের ডানায় ভর করে প্রবাসে পা রেখেছিল। কিন্তু তার সেই স্বপ্ন আর পূরণ হয়নি। একই বিছানায় কেটে যায় তার একটি বছর। এই সময়ের মধ্যে একবারের জন্যও দাঁড়াতে পারেনি নিজের পায়ে। অন্যের সহযোগিতা ছাড়া নিজ হাতে খেতে পারেনি কোনো খাবার।
২০১৪ সালের অক্টোবর মাসে সিলেট হবিগঞ্জের এই প্রবাসীকে নিয়ে স্থানীয় গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলে ওই সময় বাংলাদেশ সোশ্যাল ক্লাব দুবাই হারুনের পাশে দাঁড়ায়। মানবতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে হারুনের ভরণ-পোষণ ও আইনি সব সহযোগিতায় সোশ্যাল ক্লাবের সভাপতি নওশের আলীর নেতৃত্বে এগিয়ে আসেন সংগঠনের অন্য কর্মীরা। আইনি লড়াইয়ে লড়তে সহযোগিতার আশ্বাস দেন আবুধাবিস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস। এরপর মামলা হলো। শুরু হলো আইনি প্রক্রিয়া। কিন্তু স্থানীয় পুলিশের একটি ক্রিমিনাল কেস তখনও সচর ছিল। কথা ছিল, সেই মামলাটি নিষ্পত্তি হলে দূতাবাসের রুজু করা সিভিল কেসের শুনানি শুরু হবে। এই নিরিখেই হারুনকে দেশে পাঠানোর অনুমতি আসে। বাংলাদেশ সোশ্যাল ক্লাবের আর্থিক সহাযোগিতায় হারুন দেশে ফিরে যায়। এদিকে, দূতাবাসের নেতৃত্বে তার ক্ষতিপূরণ আদায়ে জন্য আইনজীবী আদিল আবদেল কাদির ফাখরির সঙ্গে চুক্তি করা হয়।
উপরের সব খবর পুরোনো। নতুন খবর হচ্ছে, হারুন আর আমাদের মাঝে নেই। আজ যখন হারুনের খবরটি চোখে পড়ল তখনই তার সম্পর্কে জানার আগ্রহ হলো। তার বর্তমান অবস্থা জানতে নওশের আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করি। কিছুক্ষণ পরই তিনি আমাকে দুঃসংবাদ দিলেন। তিনিও তখনই খবরটি জেনেছেন। হারুনের সম্পর্কে মামা মো. খলিল জানালেন, সে কয়েকমাস পূর্বেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন। খবরটি জেনে খুবই ব্যথিত হয়েছি। আরও বেশি কষ্ট পেয়েছি যখন জানলাম, প্রায় ৬ বছরেও হারুন পাননি তার ক্ষতিপূরণ কিংবা আর্থিক সহায়তা। তার পঙ্গুত্ববরণ, একবছর আমিরাতে দুঃসহ জীবনযাপন ও মামলা চালাকালীন সময়েও তিনি পাননি সরকারিভাবে কোনো আর্থিক সহায়তা! বিষয়টি শুধু কষ্টের নয় একজন প্রবাসী হিসেবে গভীর উদ্বেগের।
এটি অত্যন্ত হতাশা ও বেদনার। কেননা, ভাবলেই একটি জটিল সমীকরণ সামনে এসে দাঁড়ায়। আমিও একজন প্রবাসী। আমার আশেপাশে এমন কোটি হারুন রয়েছেন। তারাও রেমিট্যান্স যোদ্ধা। তারাও নিজের উপার্জিত অর্থ দেশে প্রেরণ করছেন। তাদের অর্থে দেশের রিজার্ভ বাড়ছে। কিন্তু তারা কিংবা আমরা দুঃসময়ে অবহেলার পত্রে পরিণত হতে হচ্ছে। ভাবনার বিষয় এই, এমন অনেকেই আছেন যাদের পাশে দাঁড়ানো কিংবা আর্থিক সহায়তা বা ক্ষতিপূরণের জন্য লড়াই করার মত কেউই থাকে না। নীরবে তাদের অধ্যায়ের সমাপ্ত হয়ে যায়।
হারুনের বিষয়টি টেনে নওশরে আলী আক্ষেপ করে বললেন, এই আমাদের প্রবাসীদের অবস্থা! হায় আমাদের কমিউনিটি, আমাদের নেতা। রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের নিয়ে আমাদের গর্ব, হায় অসহায় রেমিট্যান্স যোদ্ধা। কি নীরব, করুণ মৃত্যু! হারুন পঙ্গুত্বের সাথে যুদ্ধ করে মৃত্যুবরণ করেছে। কি মর্মান্তিক! কষ্টদায়ক! আমাদের কি বিশাল ব্যর্থতা। নিজেকে ক্ষমা করতে পারছিনা। সে কিংবা তার পরিবার এখন ক্ষতিপূরণও পায়নি!
হারুনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হবার পর আবুধাবিস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসেও যোগাযোগ করেছি। নিজেকেও অপরাধী মনে হচ্ছিল। ইশ, যদি আরও আগে তার বিষয়টি তদারকি করতে পারতাম। হয়ত, কোনোভাবে তার পরিবার উপকৃত হতো। হয়ত তিনি জীবিত অবস্থায় ক্ষতিপূরণের অর্থে চিকিৎসা করাতে পারতেন। কিন্তু তা আর হলোই না। তবে হারুনের বিষয়টি অবগত করার পর আবুধাবি দূতাবাসের শ্রম কাউন্সিলর লুৎফুন নাহার নাজিম দ্রুততার সহিত তার মামলার নিষ্পত্তির বিষয়ে কাজ করবেন বলে জানালেন।
তবুও যে প্রশ্ন থেকে যায়! আর কত হারুন চলে গেলে ঘুম ভাঙবে আমাদের ? বাজেটে কি আদৌ বরাদ্দ থাকবে প্রবাসীদের আইনি সহায়তা কিংবা দুঃসময়ে আর্থিক সহায়তার বিষয়টি! অথবা সরকারিভাবে প্রতিজন প্রবাসীর দুঃসময়ে সরাসরি পাশে থাকার অঙ্গিকার কি আমরা আদৌ পাবো ? এই বিষয়গুলো নিয়ে প্রবাসীদের ঐক্যমতে আসা কি প্রয়োজন নেই ? নাকি আমরা কেবল মিথ্যে মিথ্যে কমিউনিটির নেতা হয়ে ভুলে থাকব প্রবাসীদের এসব স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়! সময় অনেক অতিবাহিত হয়েছে কিন্তু শেষ হয়ে যায়নি। আমাদের উচিত, প্রবাসীদের উচিত সংগঠিত হওয়া।
প্রবাসীদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে সুনির্দ্দিষ্টভাবে গুরুত্ব দেওয়া। সরকারের নজরে আনা। নিজেদের প্রাপ্ত অধিকার বুঝে নেওয়া। এজন্য অবশ্যই দল-মত নির্বিশেষে সমষ্ঠিগতভাবে প্রবাসীদের অধিকার সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করার লক্ষ্যে সংগঠন প্রয়োজন। যে সংগঠনের নেতারা প্রবাসীদের এসব বিষয়গুলো নিয়ে গুরুত্ব সহকারে কাজ করবেন। যারা তাদের মূল্যবান চিন্তা ও সময় ব্যয় করবেন সাধারণ প্রবাসীদের কল্যাণে। আর কোনো প্রবাসী হারুনের এমন দুঃসময় আসার আগে এই একজন হারুনই আমাদের ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলুক। এই প্রত্যাশা করি।
কামরুল হাসান জনি
দুবাই ; ৩ জুন ২০২১
Discussion about this post