আতিক খান: বিয়ের পর ১ম কুরবানী ঈদে শিপে ছিলাম। শ্বশুর বাড়ি চট্টগ্রামের হলেও শাশুড়ি চট্টগ্রামের নন। আমাদের পারিবারিক কালচার সম্পর্কে উনারা নিশ্চিত ছিলেন না। তাই না চাওয়া সত্ত্বেও কুরবানীর দুই দিন আগে একটা ছাগল এসে বাসার আঙ্গিনায় ম্যাঁ ম্যাঁ করতে লাগল, শ্বশুর বাড়ির উপহার। আব্বা আম্মা সহজভাবে নিলেন না। উনাদের ভদ্রভাবে বুঝিয়ে দেয়া হল, যেন এরকম আর কখনো না পাঠায়। আমাদের নিজস্ব গরু ছাগল কেনা হয়েছে এবং কেনার সামর্থ্য আছে। উপহারের পশু দিয়ে কুরবানী করার কোন ইচ্ছা আমাদের নাই। গত দেড় দশকে তাই আর আসেনি।
এই গরু বা ছাগল উপহারের ভিত্তি কি? কুরআনের পরিস্কার নির্দেশনা হল, যাদের সামর্থ্য আছে কুরবানী একমাত্র তাদের জন্যই প্রযোজ্য। আর যাদের সামর্থ্য নেই, তাদের কুরবানী করা জরুরী নয়। তাই এই উপহার দেয়া না দেয়ায় কিছু আসে যায় না। অন্যের উপহারে কারো উপর ওয়াজিব হওয়া কুরবানী গ্রহনযোগ্য হবে না। এটা অনেকটা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও সরকারী খয়রাতে হজ করার মত।
যার গরু ছাগল কেনার সামর্থ্য নেই সে হাঁস মুরগী খেতে পারে। নইলে বাজার হতে খোলা মাংস কিনতে পারে। অথবা যারা কুরবানী করেছে তাদের কাছ থেকে উপহার বা হক হিসেবে নিতে পারে। শ্বশুরবাড়ির টাকায় কেন পায়ের উপর পা তুলে আয়েশ করে পরোটা মাংস চিবাতে হবে? এটাও এক ধরনের যৌতুক, এবং ইসলামী কালচারে বর্জনীয়। আমরা বাঙালি মুসলিমরা সত্যিকার ইসলাম চর্চা হতে বহু বহু দূরে। মেয়ের ফ্যামিলি হতে যত কিছু ফ্রি পাওয়া যায় ততই আমাদের দাঁতের পাটি চওড়া হতে থাকে। ফ্রি পেতে কে না ভালবাসে।
এই জঘন্য সংস্কৃতি প্রচলনের উৎস কোথা থেকে? বাংলাদেশের অন্য কোন জেলা কিংবা ভিন্ন কোন ধর্মে কি এরকম আচার আচরণ এর প্রচলন আছে? আমরা পাঠাতে মানা করেছিলাম ২০ বছর আগে।
পরিস্থিতির কি উন্নতি হয়েছে? অনেক ছেলের পরিবার বা আত্মীয়স্বজনই এজন্য মেয়ের পরিবারে চাপ প্রয়োগ করেন। আর কাউকে কাউকে দেখি ধারকর্জ করে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে এসব গরু ছাগল উপঢৌকন পাঠাতে। নইলে মেয়েকে অনেক আজেবাজে কথাবার্তা শুনতে হয় এবং ক্ষেত্রবিশেষে শারীরিক নির্যাতনও হয়ে থাকে। পরিবারের গন্ডিতেই তুলনা দিয়ে বলা হয়, অমুক বউয়ের বাপেরবাড়ি হতে তো ঠিকই বড় গরু পাঠিয়েছে। আমাদের আর কাউকে মুখ দেখানোর উপায় রইল না।
আবার কিছুসংখ্যক মেয়েকেও দেখা যায় অগ্রবর্তী হয়ে বাবা মায়ের কাছ থেকে এসব গরু ছাগল উপহার নিতে। এরা বিয়েতেও নিজ বাবাকে অপব্যয় করানোতে অগ্রণী ভূমিকা নেয়। যদিও এজন্য মেয়ের বাবা মায়েদেরও কিছুটা দায় আছে। বেশীরভাগ পরিবার মেয়েদের প্রাপ্য সম্পত্তি বুঝিয়ে দেয় না। তাই এসব মেয়েরা অন্যভাবে আদায় করে নেয়ার চেষ্টা করে। আবার অনেক মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে নিজের অবস্থান শক্ত করার জন্য হলেও নিজ বাবা মায়ের উপর চাপ প্রয়োগ করে।
অনেক ধনী ছেলের পরিবারও ফকিরের মত এই আচরন করে থাকে। অনেকে আবার পাড়াপ্রতিবেশীকে গর্ব করে বলে বেড়ায় তাদের বেয়াই বাড়ি হতে গরু আসছে। আরে, এদের মত গরু থাকতে বেয়াই বাড়ি হতেও গরু লাগে? নিজেদের গর্ব করার মত কিছু নেই, তাই ছেলের বউয়ের বাপের বাড়ি হতে নেয়া উপঢৌকনই হয়ে দাঁড়ায় গর্বের বিষয়। এরা বুঝে না, ছেলের মাধ্যমে নিয়ে যে অসুস্থ রীতি চালু করেছে, মেয়ের মাধ্যমে সেই একই গরু ফেরত পাঠাতে হবে। চট্টগ্রামে এই অসুস্থ সংস্কৃতির প্রাধান্য থাকলেও, দেশের আরো অনেক অঞ্চলেই কম বেশী দেখা যায়। আর আমাদের দুর্ভাগ্য, খারাপ সংস্কৃতিগুলোই কিভাবে যেন বেশী জনপ্রিয় হয় এবং ছড়িয়ে পড়ে।
এই জোরজবরদস্তির উপহার মেয়ের পরিবারের উপর একটা ভয়াবহ চাপ ছাড়া কিছুই না।
বাংলাদেশের মানুষের উচিত এই কুপ্রথা এ মুহূর্ত হতে বর্জন করা এবং এই অসুস্থ কালচারকে চিরতরে দাফন করে ফেলা।
লেখক: মেরিন অফিসার।
Discussion about this post