অর্থসঙ্কটে কেউ ছাড়ছেন ঢাকা, কেউ উঠছেন কম ভাড়ার বাসায়; টিকে থাকার সংগ্রামে মধ্যবিত্তরা
ভাড়াটিয়া পরিষদ নামের একটি বেসরকারি সংগঠনের সভাপতি বাহরানে সুলতান বাহার গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আমাদের কাছে যে হিসাব রয়েছে, তাতে এরই মধ্যে প্রায় ৫০ হাজার লোক বাসা ছেড়ে দিয়েছে।’
রাজধানীতে ভাসমান মানুষ ও বস্তিবাসীদের নিয়ে কাজ করা ‘সাজেদা ফাউন্ডেশন’-এর কর্মকর্তারা নিম্ন আয়ের মানুষের ঢাকা ছাড়ার বিষয়টি জানেন বলে নিশ্চিত করেছেন।
তবে কী পরিমাণ মানুষ করোনার প্রভাবে ঢাকা ছেড়েছে এর কোনো পরিসংখ্যান নেই সরকারি কোনো দপ্তর বা সিটি করপোরেশনের কাছে।
২০১১ সালের সর্বশেষ আদমশুমারি অনুসারে, রাজধানীর জনসংখ্যা এক কোটি ৭০ লাখ। ভাড়াটিয়া পরিষদের হিসাব মতে, এর মধ্যে ৮০ শতাংশ লোক ভাড়ায় বসবাস করে। সে হিসাবে ঢাকা শহরে ভাড়ায় থাকে এক কোটি ৩৬ লাখ মানুষ।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, করোনার কারণে মানুষের জীবনে বিপর্যয় নেমে এসেছে। আর্থিক বিপর্যয়ের কারণে সমাজের শ্রেণি কাঠামোতে পরিবর্তন ঘটে গেছে।
গত ৮ জুন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি একটি জরিপ তথ্য প্রকাশ করেছে। ওই জরিপে বলা হয়েছে, সাধারণ ছুটির ৬৬ দিনে দেশের তিন কোটি ৫৯ লাখ ৭৩ হাজার ২৭১ জন লোক চাকরি বা উপার্জন হারিয়েছেন। করোনার বিস্তার ঠেকাতে সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটির আগে দেশে মোট দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ছিল তিন কোটি ৪০ লাখ। ছুটির ৬৬ দিনেই ‘নবদরিদ্র’ মানুষের সৃষ্টি হয়েছে। দরিদ্র মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ছয় কোটি ৮০ লাখে।
অর্থনীতি সমিতির মতে, সাধারণ ছুটির কারণে বহুমাত্রিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে অনানুষ্ঠানিক খাতের ব্যবসা। বিশেষ করে ফেরিওয়ালা, হকার, ভ্যানে পণ্য বিক্রেতা, চা-পান-সিগারেট, খুদে দোকান, মুদি দোকান, ক্ষুদ্র হোটেল, রেঁস্তোরা, মাঝারি পাইকারি ব্যবসা। সারা দেশে এ ধরনের ব্যবসায়ীর সংখ্যা ৮৬ লাখের ওপরে। তাদের ওপর নির্ভরশীল সাত কোটি ৮০ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা। যারা দেশের মোট জনসংখ্যার ৪৬ শতাংশ।
প্রায় ১০ বছর পর পরিবারের লোকজনকে গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের নগরকান্দায় পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন রাজধানীতে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা তৌহিদ আহমেদ। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘বাড়িভাড়ার চাপে অসহ্য হয়ে পড়েছি। বেতন অনিয়মিত, তাই গ্রামে ঘর মেরামত করে পরিবার বাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি।’
রাজধানীজুড়ে এখন শুধু ‘টু-লেট’-এর ছড়াছড়ি। কেন এমন, তা সবারই আঁচ করার কথা। সাড়ে চার মাস হলো করোনা হানা দিয়েছে দেশে। এর মধ্যেই কাজ হারিয়েছেন কিংবা কর্মহীন হয়ে পড়েছেন অগণিত মানুষ। আয় কমেছে বহু লোকের। যার ফলে খাবারের চাহিদা মিটিয়ে বাসা ভাড়া পরিশোধ করা এদের জন্য বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। বাসা ভাড়া দিতে না পেরে অনেকেই ছেড়ে গেছেন ঢাকা। কেউবা অপেক্ষাকৃত ছোট বাসায় উঠেছেন বড় বাসা ছেড়ে। আবার কেউবা শহরের উপকণ্ঠে কম টাকার ভাড়ার বাসায় আশ্রয় গড়েছেন। মার্চের শেষ দিকে সরকারি ছুটির পর, সেই যে ঢাকা থেকে গ্রামে গেছেন, এখনো ফেরেননি এমন সংখ্যাও আছে অনেক।
করোনাভাইরাসের প্রভাবে শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, নির্মাণসহ সব খাত স্থবির হয়ে পড়ায় গত কয়েক মাসে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন রাজধানীর লাখ লাখ মানুষ। কাজ হারিয়েছেন গৃহশ্রমিক, পোশাকশ্রমিক, নির্মাণশ্রমিক, হোটেলশ্রমিক থেকে শুরু করে সব খাতের শ্রমজীবীরা।
সরকারি-বেসরকারি সহায়তায় কিছু নিম্নবিত্ত পরিবারের খাদ্যের সংস্থান হলেও দিতে পারছেন না ঘরভাড়া। ফলে গত কয়েক মাসে অসংখ্য পরিবার রাজধানী ছেড়ে পাড়ি দিয়েছে গ্রামে। কয়েক মাসের ঘরভাড়া বকেয়া পড়ায় অনেকে মালপত্র রেখেই চলে গেছেন।
মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নি মধ্যবিত্তরা অর্থসঙ্কটে পড়েছেন। ভালো চাকরি করলেও কোনো কোনো অফিস বেতন কমিয়ে দিয়েছে কিংবা লোক কমানোর তালিকায় নাম উঠে যাওয়ায় এখন চোখে সরষে ফুল দেখছেন।
এমনই একজন আরিফুল হক। গুলশানে একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন তিনি। গত মাসে তার প্রতিষ্ঠান পাওনা চুকিয়ে দিয়ে ১৫ ভাগ জনবল কমিয়েছে। আরিফুল হক বলেন, ‘পরিবার নিয়ে এখন মহাসঙ্কটে পড়েছি। করোনার এই সময়ে চাকরি পাওয়া কঠিন। কী যে করব বুঝতে পারছি না।’
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে অর্থাভাবে মানুষ বাসা ছেড়ে দিচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে ভাড়া কমিয়ে হলেও ভাড়াটিয়া রাখার চেষ্টা করছেন অনেক বাড়িওয়ালা। কিন্তু কাজ না থাকায় সেই সামর্থ্যও নেই অনেকের।
শাহজাদপুরে এশিয়ান হোমস সিটি ব্যাংকের ভবনে বাসা ভাড়ার জন্য সম্প্রতি বিজ্ঞাপন দিয়েছেন এক বাড়িওয়ালা। তিনি জানান, ভাড়াটিয়া মালামাল রেখেই বাড়ি চলে গেছেন। আর আসবেন না বলে জানিয়েছেন। এখন ৩০ হাজার টাকার বাসা ১৮ হাজার টাকায়ও কেউ নিচ্ছে না।
রাজধানীর ভাটারা থানাধীন ছোলমাইদ এলাকায় একটি তিনতলা ভবনের নিচতলায় তিন বেডরুমের ‘ব্যাচেলর’ ফ্ল্যাটে সাড়ে চার হাজার টাকা দিয়ে থাকছেন মাত্র একজন। দুই মাস আগেও তাকে ভাড়া দিতে হতো পাঁচ হাজার টাকা। তখন অন্য দুই কক্ষে আরো দু’জন ছিল। কাজ না থাকায় ভাড়া কমিয়েও অপর দু’জনকে রাখতে পারেননি বাড়িওয়ালা। করোনা পরিস্থিতির আগে ফ্ল্যাটটি থেকে বাড়িওয়ালা পেতেন মাসে ১৫ হাজার টাকা। পুরো ফ্ল্যাটে একজন থাকলেও তাকে সেই ভাড়া পরিশোধ করতে হতো। ওই ভবনেরই তিনতলায় সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে পুরো ফ্ল্যাট নিয়ে থাকছেন আরেকজন।
এ দিকে গত দুই মাসে এই এলাকা থেকেই শতাধিক পরিবার ঘর ছেড়ে চলে গেছেন। অধিকাংশ বিল্ডিংয়ে ঝুলছে ‘টু-লেট’ লেখা সাইনবোর্ড। অনেকেই ভাড়া বকেয়া পড়ায় মালপত্র রেখে চলে গেছেন। ভাটারার ছোলমাইদ ও বসুমতি এলাকার টিনশেড ঘরগুলোতে বসবাস মূলত গৃহকর্মী, রিকশাচালক ও নির্মাণশ্রমিকদের। এর মধ্যে কিছু রিকশাচালক টিকে থাকলেও করোনার কারণে কাজ হারিয়েছেন অধিকাংশ গৃহকর্মী ও নির্মাণশ্রমিক। ওই এলাকার বাড়িওয়ালা হাজী বদরউদ্দিনের আটটি ভাড়াটিয়া পরিবার গত তিন মাসে ঘর ছেড়েছে।
বদরউদ্দিন জানান, বটগাইছ্যাবাড়ি এলাকায় তার টিনশেড ভাড়া ঘর থেকে করোনা পরিস্থিতির শুরুতেই তিনটি পরিবার ভাড়া না দিয়ে চলে গেছে। তাদের ঘরগুলোতে তেমন কোনো মালামালও ছিল না। এ ছাড়া বালুর মাঠ এলাকায় তার টিনশেড ভাড়াঘর থেকে আরো চার ভাড়াটিয়া ঘরে তালা দিয়ে চলে গিয়েছিল। গত মাসে তাদের দু’জন এসে অনুনয়-বিনয় করায় ৩-৪ হাজার টাকা মওকুফ করে ছেড়ে দেন। এ ছাড়া দুই মাস আগে তার আরেকটি ফ্ল্যাট বাসা ভাড়া নেন এক নারী। দু-একদিনের মধ্যে অগ্রিম টাকা দেবেন জানিয়ে ঘরে কিছু মালপত্র রেখে তালা দিয়ে চলে যান। এখন পর্যন্ত ফেরেননি। ফোনেও তাকে পাওয়া যাচ্ছে না।
কুড়িলের কুড়াতলি এলাকায় একটি কক্ষ সাড়ে তিন হাজার টাকায় ভাড়া নিয়ে থাকতেন চারজন। একজন ফুটপাথে কাপড় বিক্রি করেন। দু’জন রাজমিস্ত্রির সহকারী (নির্মাণশ্রমিক)। মাসুম নামের অপরজন একটি সুপারশপের কর্মচারী। কাজ না থাকায় এপ্রিলের শুরুতে জামালপুরে গ্রামের বাড়ি চলে যান নির্মাণশ্রমিক দু’জন। তাদের দুই মাসের ভাড়া বকেয়া পড়ায় বাড়িওয়ালা অপর দু’জনকে চাপ দেন। ফোন করলে নির্মাণশ্রমিক দুজনই টাকা পাঠাতে অপারগতা জানান। সেই সাথে বাসা ছেড়ে দেয়ার কথা বলে দেন। বাধ্য হয়ে অপর দু’জন কিছু টাকা জোগাড় করে বাড়িওয়ালাকে শান্ত করেন।
গত মে মাসের মাঝামাঝি আকস্মিক সুপারশপের চাকরিটি হারান মাসুম। এরপর থেকে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন কাজের আশায়। আজ পর্যন্ত কোনো কাজ মেলেনি। মাসুম বলেন, এখন যে ঘরভাড়া পরিশোধ করে বাড়ি চলে যাবো সেই টাকাই নেই। কী খাব, কী করব?
এ দিকে পশ্চিম রাজাবাজার এলাকায় গিয়ে দেখা যায় অধিকাংশ ছাত্র মেসগুলোয় ‘সিট/রুম ভাড়া হবে’ লেখা সাইনবোর্ড ঝুলছে। বাড়িগুলোর কেয়ারটেকারদের সাথে কথা বলে জানা যায়, স্কুল-কলেজ বন্ধের পরই শিক্ষার্থীরা চলে গেছেন। দেড়-দুই মাস পরে অনেকে ফোন করে বাসা ছেড়ে দেয়ার কথা জানিয়ে দিয়েছেন। বকেয়া ভাড়াও পাঠাচ্ছেন না। অনেক মেস পুরোপুরি খালি হয়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে অনেক ভবনের কেয়ারটেকারের বেতনও আটকে আছে। এমনকি চাকরি না থাকার শঙ্কাও কাজ করছে তাদের মধ্যে।
এ দিকে সন্তানের স্কুলসহ নানা বিষয়ে রাজধানীর সাথে জড়িয়ে যাওয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণী শেষ সম্বল খরচ করে টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করছেন। অনেকেই ভাড়া কমাতে ফ্ল্যাট বাসা ছেড়ে উঠছেন শহর থেকে দূরে টিনশেড ঘরে। বড় ফ্ল্যাট ছেড়ে উঠছেন ছোট ফ্ল্যাটে। করোনা সঙ্কটের কালো মেঘ কবে কাটবে, সেই আশায় এখন দিন গুনছেন তারা।
Discussion about this post