কামরুল হাসান জনি : দীর্ঘ ১০ বছরের বেশি সময় সংবাদকর্মী হিসেবে কাজ করছি সংযুক্ত আরব আমিরাতে। এ সময়ের মধ্যে যতটুকু দেখছি- দুবাই, শারজা ও আবুধাবি এই ৩ প্রদেশে অন্যান্য প্রাদেশিক শহরের তুলনায় সংগঠন বেশি, সংগঠক বেশি এবং মানবিক কাজও হয় বেশি। সে তুলনায় আজমান, ফুজাইরা, রাস আল খাইমা ও উম্ম আল কোয়াইনের প্রবাসী বাংলাদেশিরা নানাদিক থেকে অনেকটাই পিঁছিয়ে থাকেন।
৩ টি প্রদেশের মধ্যে ফুজাইরাতে বাংলাদেশ সমিতি, রাস আল খাইমাতে বাংলাদেশ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, উম্মুল কোয়াইন বাংলাদেশ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র রয়েছে। তবুও প্রবাসীদের কাছে সহযোগিতা বা সহায়তা খুবই ধীরগতিতে পৌঁছায়। কোথাও কোথাও অনেকে থেকে যাচ্ছেন একেবারেই আড়ালে।
আমিরাতের সাতটি প্রদেশ আবুধাবি, দুবাই, শারজা, আজমান, উম্ম আল কোয়াইন, ফুজাইরা ও রাস আল খাইমা। এই প্রাদেশিক শহরগুলোতে প্রায় সাত লাখ বাংলাদেশি নানাভাবে বসাবস করছেন। সাতটি প্রদেশে বাংলাদেশিদের রাজনৈতিক সংগঠন, সামাজিক ও আঞ্চলিক সংগঠন মিলে প্রায় দুইশ’ সংগঠন রয়েছে। রাজনৈতিক সংগঠনগুলো গ্রুপিং এর কারণে কোনো কোনো বিভাগে একাধিক শাখাও পরিচালিত হচ্ছে।
তবে যারা বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনে জড়িত আছেন তারা আবার কোনো না কোনো সামাজিক সংগঠন বা আঞ্চলিক সংগঠনেও নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এই হিসেবে ধরা যাক, একটি সংগঠনে যদি ২৫ থেকে ৩০ জন করে সক্রিয় সদস্য থেকে থাকেন তাহলে মাত্র পাঁচ কিংবা ছয় হাজার প্রবাসী আছেন যারা ভিন্ন ভিন্ন সংগঠনে সাংগঠনিকভাবে সংঘবদ্ধ।
যদিও কমিউনিটি বলতে সাধারণত হাতেগোনা মাত্র অর্ধশত ব্যক্তিকেই বারবার দেখা যায়। তবুও প্রতিটি সংগঠন থেকে যদি তিনজন করে সদস্য কমিউনিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা যায় তাহলে এই সংখ্যা দাঁড়ায় মাত্র ৬০০ জনে। সাত লাখ প্রবাসীর তুলনায় এই ৬শ জন খুবই অল্প সংখ্যক লোক। গাণিতিক হিসেবে ৬শ’ কিংবা ওই ৩০ হাজারের বিপরীতে জানাশোনার বাইরে থেকে যাচ্ছেন প্রায় ৬ লাখ ৭০ হাজার প্রবাসী বাংলাদেশি।
বড় এই সংখ্যার প্রবাসীরা বিভিন্ন সময় নানা জটিলতায় পড়েন। কেউ চাকরি হারিয়ে আর্থিক সংকটে থাকেন। কেউ ভিসার মেয়াদ চলে যাবার পরও বিমান টিকিটের জন্য দেশে ফিরে যেতে পারেন না। কেউবা জটিল কোনো রোগে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসার অভাবে পড়ে থাকেন। রোগাক্রান্ত ওই প্রবাসীদের কেউ কেউ মারাও যাচ্ছেন। কখনো কখনো খবর পেয়ে কিছু সংগঠন এদের পাশে এসে দাঁড়ায়। কিন্তু কী পরিমাণ প্রবাসী বছরে এই সহযোগিতার আওতায় আসছেন সেই পরিসংখ্যান করা আমাদের সম্ভব হয়ে উঠছে না।
সংযুক্ত আরব আমিরাতে বৃহত্তর এই জনগোষ্ঠীর জন্য নেই বাংলাদেশিদের তেমন কোনো চ্যারিটি বা দাতব্য সংস্থা। জানা গেছে, আমিরাতে স্থানীয় আইন অনুসরণ করে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, খলিফা ফাউন্ডেশন, নুর দুবাই, আল মাকতুম ফাউন্ডেশন, ধার আল বার সোসাইটি ও দুবাই কেয়ার এর মত বৃহত্তর বেশকিছু দাতব্য সংস্থা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এরা স্থানীয়দের পাশাপাশি প্রবাসীদের কল্যাণেও কাজ করেন। আবার পাকিস্তানি ও ভারতীয় কিছু দাতব্য সংস্থা আছে যারা শুধুমাত্র তাদের নাগরিকদের সেবায় নিয়োজিত।
তবে বাংলাদেশিদের সামাজিক ও আঞ্চলিক সংগঠনগুলো নিজেদের সদস্যদের মাধ্যমে অর্থ উত্তোলন করে বা কোনো পৃষ্ঠপোষক থেকে আর্থিক সহায়তা নিয়ে অসহায় প্রবাসীদের পাশে দাঁড়ান। কিন্তু সামাজিক সংগঠন ও আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর আমিরাতে বৈধ নিবন্ধন না থাকায় আর্থিক সহায়তা উত্তোলনের দায়ে যেকোনো সময় বড় অংকের জরিমানার মুখোমুখি হবার আশংকা খুবই বেশি থাকে। সংগঠন করলেও কেউ কেউ হয়ত এই জরিমানার বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নন।
তবে আমিরাতে বাংলাদেশিদের নিবন্ধিত একটি সম্মিলিত চ্যারিটি সংস্থা থাকলে প্রবাসীরা যে বেশ উপকৃত হতেন এটি সহজে অনুমেয়। বিশেষ করে- যেসকল প্রবাসী বিদেশে মৃত্যুবরণ করছেন তাদের লাশ দেশে পাঠানোর ক্ষেত্রে সহযোগিতা প্রদান, যারা কর্মহীন থাকেন তাদের পাশে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে, রোগাক্রান্ত প্রবাসীদের চিকিৎসা সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে এই সংস্থা সম্মানজনক অবস্থান থেকে কাজ করতে পারে। দালাল চক্রের খপ্পরে পড়া অসহায় নারী কিংবা পুরুষ শ্রমিকদের পাশে দাঁড়াতেও সহায়ক হত এটি। আবার প্রবাসে যেকোনো দুর্যোগকালীন প্রবাসীদের সরাসরি সহাযোগিতা করতে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারবে এই সংস্থা।
করোনাকালীন আমরা দেখেছি বেশ কিছু সামাজিক সংগঠন, আঞ্চলিক সংগঠন ও কিছু রাজনৈতিক সংগঠন আলাদা আলাদাভাবে প্রবাসীদের খাদ্য ও নগদ অর্থ সহায়তা দিয়েছেন। কিন্তু এর কোনো হিসাব বা পরিমাণ নথিভুক্ত হয়নি। যদিওবা সরকারিভাবে প্রায় কোটি টাকা সহযোগিতা প্রদানের খবর গণমাধ্যমে এসেছে। কিন্তু একটি চ্যারিটি সংস্থা থাকলে অন্তত নির্ণয় করা সহজ হতো- কি পরিমাণ প্রবাসী সরকারি সহযোগিতার আওতায় এসেছেন আর কতজন প্রবাসী ওই চ্যারিটি সংস্থা থেকে সহায়তা পেয়েছেন। একটি চ্যারিটি সংস্থা গঠন করা বা প্রতিষ্ঠা করা খুব যে কঠিন কাজ তার কিন্তু নয়। আমিরাতে বেশ কয়েকজন গুণী সংগঠক আছেন। রয়েছেন সরকারি নিবন্ধিত বাংলাদেশ সমিতির দক্ষ সভাপতি-সম্পাদকরা।
এছাড়াও কমিউনিটিতে প্রথম সারিতে নেতৃত্বে রয়েছেন ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা। বাংলাদেশ দূতাবাস বা দুবাই কনস্যুলেট উদ্যোগী হলে খুব দ্রুতই সামাজিক সংগঠন ও আঞ্চলিক সংগঠনগুলোকে একত্রিত করে বৃহত্তর একটি চ্যারিটি সংস্থা চালু করা সম্ভব। একটি বিষয় এখানে যোগ করতেই হয়- বিভিন্ন সংগঠন ভিন্ন ভিন্ন নীতি আদর্শে বিশ্বাসী ও ভিন্ন ভিন্ন ধারায় পরিচালিত হবার কারণে সাধারণ প্রবাসীরা চাইলেও এসব সংগঠনে নিজেদের অংশগ্রহণ বা সামর্থবান প্রবাসীরা আর্থিক সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে আসতে পারেন না।
বিশেষ করে যারা খুবই সাধারণ কাজকর্মে নিয়োজিত তারা একপ্রকার দূরেই থেকে যান। আমার বিশ্বাস- মানবিক দৃষ্টিতে অসহায় প্রবাসীদের পাশে দাঁড়াতে দল-মত নির্বিশেষে সম্মিলিতভাবে একটি চ্যারিটি সংস্থা আরব আমিরাতে প্রতিষ্ঠা করা গেলে সকল শ্রেণি পেশার প্রবাসীরা এই সংস্থায় আর্থিক অনুদান প্রদান করতে পারেন। পাশাপাশি নিজেদের সর্বোচ্চ সহায়তা দিয়ে অসহায়দের পাশে দাঁড়াবেন। একই ধারায় জবাবদিহিতার মাধ্যমে এই সংস্থাটি প্রবাসীদের কাছে প্রতিষ্ঠানিক দায়ও পরিশোধ করবে।
লেখক: সাংবাদিক।
যুগ্ম সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রেস ক্লাব ইউএই।
Discussion about this post