সংযুক্ত আরব আমিরাত বাংলাদেশিদের জন্য দুবাইয়ে ভ্রমণ বা কাজের উদ্দেশ্যে ভিসা কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে এই স্থগিতাদেশ কার্যকর রয়েছে এবং এক বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসেনি ভিসা পুনরায় চালুর বিষয়ে। ফলে দেশটিতে যেতে আগ্রহী লাখ লাখ বাংলাদেশি নাগরিকের জন্য এই পরিস্থিতি রীতিমতো অনিশ্চয়তা ও হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরই মধ্যে কয়েকটি গণমাধ্যমে সম্প্রতি ‘বাংলাদেশসহ ৯ দেশের ওপর ভিজিট ও কাজের ভিসায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। ২০২৬ সালের জানুয়ারি থেকে নতুন এই নির্দেশনা কার্যকর হবে’ এমন খবর ছড়িয়ে পড়েছে। এ বিষয়ে আমিরাতের সরকারি ওয়েবসাইটে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকেই দেশটির ভিসা কার্যক্রম বাংলাদেশি অভিবাসীদের জন্য বন্ধ থাকার পর নতুন করে এমন নির্দেশনা পুনরায় দেওয়া হচ্ছে কেন? এ নিয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঢাকাস্থ সংশ্লিষ্ট দূতাবাসের কাছে জানতে চেয়েছে। এখনো নতুন নির্দেশনা এসেছে কি না এ বিষয়ে দূতাবাস নিশ্চিত করে কিছু জানায়নি বলে জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্ভরযোগ্য সূত্র।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে যে, বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা কার্যক্রম দুবাই সহজে খুলছে না। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া এই ভিসা স্থগিতাদেশ বহু বাংলাদেশির কর্মসংস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও পারিবারিক ভ্রমণের পরিকল্পনা স্থগিত রাখতে বাধ্য করেছে। এতে অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন বহু ভিসাপ্রত্যাসীরা।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে দুবাইয়ে দু-দিনব্যাপী ওয়ার্ল্ড গভর্নমেন্টস সামিটে অংশগ্রহণ করে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বাণিজ্যমন্ত্রী থানি বিন আহমেদ আল জেয়ৌদিকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশি নাগরিকদের ওপর থেকে ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং আরও বাংলাদেশি কর্মী নিতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রতি আহ্বান জানান। এরপর নানাভাবে কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে ঢাকাস্থ আরব আমিরাতের দূতাবাসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা নিয়মিত যোগাযোগ করেও এখনো ভিসা কার্যক্রম শুরুর ব্যাপারে সুরাহা করতে পারেনি বলে জানায় আরেকটি নির্ভরযোগ্য সূত্র।বাংলাদেশিদের জন্য যেভাবে বন্ধ হলো দুবাইয়ের ভিসা
বাংলাদেশের অধিকাংশ অভিবাসীর অন্যতম গন্তব্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। আরব আমিরাতে বর্তমানে বৈধ অবৈধ মিলিয়ে প্রায় ১২ লাখ বাংলাদেশি অভিবাসী বসবাস করছেন। প্রতি বছরই দেশটিতে কাজের জন্য অনেক বাংলাদেশি পাড়ি জমান। তবে ভুয়া নথি প্রদানসহ নানা অনৈতিক কাজের কারণে বাংলাদেশিদের দেশটি থেকে ফেরত পাঠানোর ঘটনা অহরহ ঘটে।
গত বছরের জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের সময় বাংলাদেশের আন্দোলনে একাত্বতা প্রকাশ করে আরব আমিরাতে অবস্থান করা প্রায় শতাধিক বাংলাদেশি বিক্ষোভ করে। বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের ডাক দেওয়ায় ৫৭ জনের মধ্যে তিনজনকে যাবজ্জীবন, ৫৩ জনকে ১০ বছরের জেল, আর একজনকে অবৈধভাবে আরব আমিরাতে থাকায় এক বছর অতিরিক্ত কারাদণ্ড দেওয়া হয়। পরে নানা কুটনৈতিক তৎপরতার পর দুবাইয়ের প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান তাদের দোষী সাব্যস্তদের দণ্ড মওকুফ ও ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। পরে গেল বছরের সেপ্টেম্বরে দুবাই অনানুষ্ঠানিকভাবেই বাংলাদেশিদের ভিসা প্রদান বন্ধ করে।
এ নিয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘দেখুন নানা কারণে দুবাইয়ের ভিসা দেওয়া বন্ধ রয়েছে। বিষয়টি এমন নয় যে, গত বছর দেশটিতে বাংলাদেশিরা যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে তার জন্য এটি বন্ধ রয়েছে। আমাদের দেশের অনেকেই সেখানে গিয়ে নানা অপকর্মে জড়িত থাকেন, সুতরাং সবকিছু বিবেচনা করেই তারা ভিসা বন্ধ রেখেছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে কূটনৈতিক উপায়ে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু কবে নাগাদ তা চালু হবে বলা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশিদের ভুয়া নথি দেওয়ার প্রবণতা
বিদেশে অভিবাসনের জন্য যাবার ক্ষেত্রে বাংলাদেশিদের অধিকাংশই ভুয়া নথি ব্যবহার করেন। যার ফলে নিরাপত্তা-সংক্রান্ত উদ্বেগ ও ভিসা জালিয়াতির ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আরব আমিরাতের নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কাজের জন্য যেসব বাংলাদেশি পাড়ি জমান, তাদের মধ্যে শিক্ষা-সংক্রান্ত তথ্যে ভুয়া নথি দেওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি। অনেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, চুয়েট, রুয়েটের সার্টিফিকেট নকল করে দুবাইয়ে ওয়ার্ক ভিসায় যান। তারা সাধারণত দেশটিতে উচ্চপর্যায়ে চাকরি করেন না। এসব ভুয়া নথি দিয়ে তারা ক্লিনার, ওয়েটারসহ ছোট কাজে যুক্ত হন।
জানতে চাইলে আরব আমিরাত দূতাবাসের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বাংলাদেশিদের ভুয়া নথি দেওয়ার প্রবণতা যে বেশি তা দেশটি জানে। এখানে অনেক কর্মী রয়েছেন, যারা কি না বুয়েটের সার্টিফিকেট নকল করে দেশিটিতে ক্লিনার, ওয়েটার, ড্রাইভিংসহ নানা ছোট পেশায় নিয়োজিত। এসব ভুয়া তথ্যের জন্য এখন অনেক সঠিক ফাইলও অগ্রহণযোগ্য হয়ে যায়।’
এসব প্রবণতার ফলে বাইরের দেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি খারাপ হচ্ছে জানিয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘ভুয়া নথি দিয়ে ভিসা নেওয়া এক ধরনের জালিয়াতি। এসব কারণে অনেকে দেশটিতে জেল ও খাটেন। তাই ভুয়া নথি দেওয়ার প্রবণতা বন্ধ না হলে বাংলাদেশিদের জন্য অভিবাসন নীতি কঠোর হবে।’
সহজেই খুলছে না আরব আমিরাতের ভিসা
গত সেপ্টেম্বরে আরব আমিরাতের ভিসা বন্ধ হওয়ায় অনেক এজেন্সিসহ ভিসাপ্রত্যাসীরা বিপাকে। এ সমস্যার সমাধান দ্রুতই হবে না বলে কালবেলাকে নিশ্চিত করেছে সংশ্লিষ্ট একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র। তবে এ ভিসা কার্যক্রম বন্ধে শুধুমাত্র ভুয়া নথি বা জালিয়াতির প্রবণতাই একমাত্র নয় বলছেন সংশ্লিষ্ট সূত্র। নানা কূটনৈতিক তৎপরতার পরও তাদের পক্ষ থেকে ভিসা কবে নাগাদ খুলবে তা নিশ্চিত করা হয়নি। তবে এ বছরের মধ্যে ভিসা খুলছে না তা নিশ্চিতভাবে বলা চলে। সমস্যা সমাধানে চেষ্টা চলছে।
এদিকে আরেক নির্ভরযোগ্য সূত্র কালবেলাকে জানায়, চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনার দায়িত্ব নিতে চায় দেশটি। সংযুক্ত আরব আমিরাতের বন্দর পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ডিপি ওয়ার্ল্ডকে জিটুজি ভিত্তিতে দীর্ঘ মেয়াদে এ টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়টি এখনো ঘুরপাক খাচ্ছে। ফলে এ নিয়ে একটি কার্রযকর সমাধান চাইছে আরব আমিরাত। এ বিষয়টি সুরাহার সঙ্গে ভিসার বন্ধের সম্পর্ক থাকতে পারে বলে বলছে নির্ভরযোগ্য সূত্রটি।
ভিসা নিয়ে দুবাই কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, পরিস্থিতি পর্যালোচনার পর ধাপে ধাপে ভিসা চালু হতে পারে। তবে নির্দিষ্ট সময়সীমা এখনো অনিশ্চিত।
সূত্র- কালবেলা
Discussion about this post