মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে গত এক বছর ধরে সুদের হার টানা বাড়িয়ে আসছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেই ধারা থেকে বের হওয়ার চ্যালেঞ্জ নিয়ে গতকাল নিজের ‘আমলের’ প্রথম মুদ্রানীতি ঘোষণা দেন ড. আহসান এইচ মনসুর। মুদ্রানীতি পড়ে শোনান বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর হাবিবুর রহমান। গভর্নর নতুন যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছেন তাতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। আগের মুদ্রানীতিতেও লক্ষ্যমাত্রা একই ছিল। অবশ্য গত বছরের জুন পর্যন্ত তা ছিল ১০ শতাংশ। সরকারি খাতে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৭ দশমিক ৫০ শতাংশ, যা আগের মুদ্রানীতিতে ছিল ১৪ দশমিক ২ শতাংশ। আর গত বছরের জুন শেষে ছিল ১২ দশমিক ৮ শতাংশ।
দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ভোগাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। একাধিকবার সুদহার বাড়িয়েও তা নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। সর্বশেষ গত ২২ অক্টোবর মুদ্রানীতি সংশোধন করে নীতিসুদহার (পলিসি রেট) ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ১০ শতাংশে উন্নীত করা হয়। দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতিতেও আরেক দফা সুদহার বাড়ানোর ঘোষণা দিলেও শেষ পর্যন্ত উদ্যোক্তা ও বিশেষজ্ঞদের সমালোচনার মুখে তা থেকে সরে এল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকলে গত ২৫ আগস্ট নীতি সুদহার ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৯ শতাংশে উন্নীত করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর ২৪ সেপ্টেম্বর আরেক দফা বাড়িয়ে ৯ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত করা হয়। এর আগে ২০২২ সালের মে মাস থেকে নীতিসুদহার মোট ১০ বার বাড়িয়ে ৫ শতাংশ থেকে দ্বিগুণ করা হয়। উদ্যোক্তারা জানান, বর্তমান পরিস্থিতিতে সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমানো সম্ভব হবে না, এতে আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর প্রভাব পড়বে বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্য ও কর্মসংস্থানে। অর্থনীতিবিদরাও একই পরামর্শ দেন। নীতি সুদহার বাড়াতে থাকলে বিনিয়োগের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মত দেন তারা। এ পরিস্থিতির মধ্যে গত মাসে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে আসে। সার্বিক দিক বিবেচনায় এনে নীতিসুদহার অপরিবর্তিত রাখা হলো।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি মাসে সাধারণ মূল্যস্ফীতি কমে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে নামে, যা ডিসেম্বরে ছিল ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ। কয়েক মাসের মধ্যে এই প্রথম মূল্যস্ফীতি এক দুই অঙ্কের নিচে নামল। এর আগে সবশেষ গত বছরের জুনে মূল্যস্ফীতির হার এর নিচে অর্থাৎ ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ ছিল। জুলাই মাসে তা একলাফে তা একলাফে বেড়ে ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে উঠে। গতবছরের জুলাই মাস ছিল আন্দেলনের মাস, কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচির মধ্যে মাসজুড়ে অস্থিরতার কারণে পণ্য সরবরাহ ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। জিনিসপত্রের দাম আকাশচুম্বী হয়, পরে কিছুটা কমলেও উচ্চ মূল্যস্ফীতির ধারা অব্যাহত থাকে। সর্বশেষ নভেম্বরে তা কমে ১১ দশমিক ৩৩ শতাংশ এবং ডিসেম্বরে আরো কমে ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশে নেমে আসে। এর মধ্যে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা হারানোর তিন দিন পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের নেতৃত্বে বেছে নেওয়া হয় ড. আহসান মনসুরকে। তিনি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে অগ্রাধিকার দেন।
তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবার আশা করছে, নতুন মুদ্রানীতি কার্যকর করা গেলে মূল্যস্ফীতি ৭ থেকে ৮ শতাংশের মধ্যে আটকে রাখা যাবে। আগের মুদ্রানীতিতেও মূল্যস্ফীতির ৬ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে রাখার লক্ষ্য ধরা হয়েছিল, যদিও জানুয়ারিতে এই হার ছিল ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ। প্রথম দফায় নীতি সুদহার বাড়ানোর পর ড. মনসুর বলেছিলেন, মুদ্রানীতির পদক্ষেপের ফল পেতে ছয় মাস সময় লাগবে। পাঁচ মাসের ব্যবধানে শীত মৌসুমে মূল্যস্ফীতির পারদ নিচের দিকে নামল। তবে এতে সুদহার বাড়ানোর কোনো কৃতিত্ব নেই বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। তাঁরা বলছেন, শীত মৌসুমে বাজারে নতুন শাক-সবজির সরবরাহের ফলে বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম কমেছে। এর ফলে তা সার্বিক মূল্যস্ফীতিতে স্বস্তি এনে দিয়েছে।
মুদ্রানীতি ঘোষণাকালে গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, নীতি সুদহার আগের মতই অপরিবর্তিত থাকবে। যতদিন মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশের নীচে না নেমে আসে, ততদিন নীতি সুদহার কমানো হবে না। মূল্যস্ফীতি নিয়ে সবার মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এ নিয়ে কাজ করছে। রেপোর মাধ্যমে ব্যাংকগুলো এক দিনের জন্য টাকা ধার নেয়। একে বলা হয় ব্যাংকিং খাতের নীতি উপাদান (পলিসি টুলস)। এর সুদ হারকে বলা হয় নীতি সুদ হার (পলিসি রেট)। এর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে তারল্য ও বিনিয়োগ নিয়ন্ত্রণ করে।
রেপোর সুদ বাড়লে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোর তহবিল পাওয়ার খরচ আরও বাড়ে। তাতে ব্যাংক থেকে ব্যবসায়ীদের ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রেও সুদহার বেড়ে যায়। নতুন মুদ্রানীতিতে স্ট্যান্ডিং ল্যান্ডিং ফ্যাসিলিটি (এসএলএফ) ১১ দশমিক ৫০ শতাংশ ও স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি (এসডিএফ) ৮ দশমিক ৫০ শতাংশ রাখা হয়েছে।
গভর্নর বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক যে নীতি গ্রহণ করেছে; সেসব পদ্ধতি অর্থনীতিতে কাজ করছে; সব কিছুতেই সময় লাগে। সেই সময় দিতে হবে। কোনো নীতি নিলে ১২ থেকে ১৮ মাস লাগে সেটা কার্যকর হতে।
তিনি বলেন, জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি সামান্য কমেছে। সামনে মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে, তার মানে এই নয় যে সব কিছু ডাউন হয়ে গেল। চলতি বছর জুন নাগাদ আমরা আশা করছি মূল্যস্ফীতি ৭ থেকে ৮ শতাংশে নেমে আসবে।
তিনি বলেন, ব্যাংকে পরিচালকের সংখ্যা কমিয়ে আনা হবে। এছাড়া বন্ধু ও আত্মীয়স্বজনকে স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। গভর্নর বলেন, বিনিময় হারকে স্থিতিশীলতায় আনতে পেরেছি। এটা অন্যতম একটা লক্ষ্য ছিল। তবে আমি এই বলছি না যে, সেটা একই দরে থাকবে।
Discussion about this post