পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের বিভিন্ন স্টেশন পরিষ্কার করতেই ৯৫ লাখ টাকার ভিম পাউডার লেগেছে। এখানকার একটি ছোট্ট টয়লেট মেরামতে খরচ হয়েছে ২৮ লাখ টাকা। আরেকটি টয়লেটসহ বারান্দার টিন বদলে খরচ ৭৩ লাখ টাকা।
ভৌতিক খরচ দেখানো হয়েছে বিভিন্ন স্টেশন রঙ করা, লাইন সংস্কার, রেলসেতু রঙ করা, ছাউনি-প্ল্যাটফর্মের টিন বদল এমনকি স্যানিটারি উপকরণের মতো ছোট ছোট কাজে। কোথাও ছিটেফোটা কাজ হয়েছে। কোথাও কাজের কোনো অস্তিত্বই নেই। কিন্তু গায়েবি এসব কাজ দেখিয়ে তুলে নেয়া হয়েছে কোটি কোটি টাকার বিল। রেলের এমন শত শত কাজ টেন্ডার ছাড়াই ক্ষমতাসীন দলের তৃতীয় শ্রেণির ঠিকাদারদের দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে কোনো নিয়মই মানা হয়নি। ২০১৭ ও ২০১৮ সালে পশ্চিম রেলের ফাঁস হওয়া দুর্নীতির নথিপত্রে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
জানা গেছে, দুর্নীতির এ সিরিজ প্যাকেজের মোট মূল্য ৭০০ কোটি টাকা। পশ্চিম রেলের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মো. রমজান আলী ও তার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন কর্মকর্তার সিন্ডিকেট এই মহাদুর্নীতিতে জড়িয়ে রয়েছেন।
রাজশাহীতে পশ্চিমাঞ্চল রেল ভবনে এসএসএই দফতরের বারান্দার টিন পরিবর্তন ও একটি টয়লেট সংস্কারে ৭২ লাখ ৩১ হাজার ৫০২ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। রাজশাহীতে রেলের এ দফতরটি একটি ছোট্ট টিনশেড অফিস। ২০১৭ সালের ৭ জুলাই এ কাজটির কার্যাদেশ দেয়া হয় মোমিন ট্রেডার্স নামে একটি তৃতীয় শ্রেণির ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে। বিধিবদ্ধ দরপত্র আহ্বান ছাড়াই লোকাল টেন্ডার মেথড (এলটিএম) বা স্থানীয় টেন্ডার পদ্ধতিতে কোনো প্রতিযোগিতা ছাড়াই মোমিন ট্রেডার্স কাজটি পায়। কাজ সম্পাদন দেখিয়ে ওই বছরের ১ অক্টোবর ঠিকাদারকে পুরো বিল পরিশোধ করা হয়।
নথিপত্র বিশ্লেষণ করে আরও দেখা যায়, পশ্চিম রেলের প্রধান টেলিযোগাযোগ ও সংকেত বিভাগের প্রধান প্রকৌশলীর দফতরের একটি টয়লেট মেরামতে ব্যয় দেখানো হয়েছে ২৮ লাখ টাকা। এ কাজটি করেছে তৃতীয় শ্রেণির ঠিকাদার তোফা কন্সট্রাকশন। রাজশাহীতে রেল অফিসার্স মেসের একটি কক্ষের (ইসি-৪) মেরামত ও মেসের ভেতরে হাঁটার পথ সংস্কারে ব্যয় দেখানো হয়েছে ৮৯ লাখ ৪৮ হাজার ৭৮০ টাকা। এই কাজটি করেছে সরকার অ্যান্ড ব্রাদার্স।
রাজশাহীতে ভদ্রা ব্যারাকের পুকুরপাড় উন্নয়ন ও ওয়াশপিট (ট্রেন ধোয়া-মোছার শেড) সম্প্রসারণে ব্যয় দেখানো হয়েছে ২ কোটি ৪ লাখ ৯ হাজার টাকা। আশরাফুল কবির নামে একজন ঠিকাদার কাজ করেছেন বলে নথিতে উল্লেখ রয়েছে। তবে সরেজমিনে পুকুরপাড় উন্নয়নের কোনো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এদিকে উল্লাপাড়া স্টেশনের ইয়ার্ডে বালু ভরাট দেখিয়ে মোল্লাহ কন্সট্রাকশনকে ৭৩ লাখ ৪৮ হাজার ৯৩৯ টাকা বিল পরিশোধ করা হয়েছে। রাজশাহী রেল স্টেশনটি কয়েক বছর আগে রি-মডেলিংয়ের মাধ্যমে নতুন করে নির্মাণ করা হলেও জরুরি কাজ উল্লেখ করে এই স্টেশনের বুকিং কাউন্টার, ওয়েটিং রুম ও কার পার্কিং এরিয়া মেরামত দেখিয়ে আনোয়ারুল ইসলাম বাবু নামে একজন ঠিকাদারকে ৫৭ লাখ ৭৪ হাজার ৪৬৪ টাকা বিল দেয়া হয়েছে।
সিরাজগঞ্জের রায়পুর নামক স্টেশনে মালামাল ওঠা-নামার সুবিধা সম্প্রসারণের নামে ঠিকাদার আরটিসিকে ৯৭ লাখ ১৮ হাজার টাকা বিল পরিশোধ করা হয়েছে। তবে নথিপত্রে ওই কাজের ধরন উল্লেখ নেই।
রেলের সাবেক ডিজি আমজাদ হোসেনের শ্যালক পরিচয়দানকারী বদরুল আলমকে নাটোর, মাধনগর, আত্রাই ও সান্তাহার স্টেশনে রেললাইনের প্লাস্টিকের ওয়াসার সরবরাহে মোট ৯ কোটি ৯৬ লাখ ৯১ হাজার টাকার ৫টি প্যাকেজের কাজ একসঙ্গে কোনো টেন্ডার ছাড়াই দেয়া হয়। বদরুল গত আড়াই বছরে এভাবে বিনা টেন্ডারে প্রায় ১০০ কোটি টাকার কাজ করেছেন বলে রেলওয়ের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। নিয়ম ভেঙে কাজ শুরুর আগেই বদরুলকে সমস্ত বিল পরিশোধ করা হয়।
যদিও রেলের সাবেক ডিজি আমজাদ হোসেন বলেন, বদরুল তার শ্যালক নয়, এলাকায় বাড়ি। তার প্রভাব খাটিয়ে কাজ নেয়ার অভিযোগ ঠিক নয়। দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরুর পর থেকে বদরুল আত্মগোপনে রয়েছেন। এদিকে একই সময়ে কোনো টেন্ডার ছাড়াই ঢাকার আরটিসি নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন রেললাইন সংস্কারের নামে মোট ১৯টি কাজ দেয়া হয়। এসব কাজের জন্য ওই প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ২৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকার বিল পরিশোধ করা হয়েছে। কোথায়, কীভাবে কাজগুলো হয়েছে বিল-ভাউচারে তার কোনো বিবরণ নেই।
২০১৮ সালের ১৮ মার্চ ঝিনাইদহের মোবারকগঞ্জ রেলস্টেশন প্ল্যাটফর্মের ২০০ ফিট সিআই সিট পরিবর্তনসহ আনুষাঙ্গিক কাজের জন্য ৩৮ লাখ ৩৬ হাজার ৫০০ টাকার বিল পরিশোধ করা হয়। ফরমাল টেন্ডার ছাড়াই উল্লাপাড়া স্টেশনের ৩০০ ফুট সিআই সিট পরিবর্তনের জন্য ৪৮ লাখ ৯৫ হাজার টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। ২০১৭ সালের ৩ জুন দ্বিতীয় মৈত্রী ট্রেনের জন্য বেনাপোল স্টেশনে একটি টিনের শেড নির্মাণে ৮০ লাখ ৯০ হাজার ব্যয় করা হয়। একই স্টেশনের ফুটওভার ব্রিজ সংস্কার ও রঙ করা বাবদ ব্যয় দেখানো হয়েছে ৬৩ লাখ ২৯ হাজার ৫০০ টাকা।
২০১৭ সালের বন্যায় কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর, টাঙ্গাইল, পার্বতীপুর, কুমারখালী ও মোবারকগঞ্জে জরুরি সেতু প্রটেকশন খাতে ৭১ লাখ ৩৮ হাজার টাকা ব্যয় দেখানো হয়। ঈশ্বরদী বাইপাস স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম সম্প্রসারণ খাতে ৬০ লাখ ৪৩ হাজার টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। রেলওয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের শীতের পোশাক কেনা খাতে ৭ লাখ ৯৩ হাজার টাকা ব্যয় দেখানো হলেও গরমের পোশাক কেনার খাতে দেখানো হয়েছে ২৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা। বিভিন্ন স্টেশন পরিষ্কার করতে ভিম পাউডার কেনায় ৯৫ লাখ টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানাচ্ছে, পশ্চিম রেলের এসব ছোট ছোট কাজ হয়েছে প্রায় আড়াই শতাধিক প্রকল্পে। এসব কাজ ইচ্ছামতো দেয়া হয়েছে ঘনিষ্ঠ ঠিকাদারদের। তবে কোথাও আংশিক ও কোথাও কাজ না করেই ঠিকাদার ও রেলের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা যোগসাজশ করে বিপুল অংকের বিল তুলে নিয়েছেন।
এরই মধ্যে রেল ভবন থেকে পশ্চিম রেলের দুর্নীতির এসব নথিপত্র জব্দ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এখন অনুসন্ধান চালাচ্ছেন দুদক কর্মকর্তারা।
Discussion about this post