প্রবাসী। দেশের রেমিটেন্স যোদ্ধা। প্রবাস থেকে কষ্টার্জিত অর্থ দেশে পাঠিয়ে অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছেন তারা। অথচ তাদেরই হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে। বিদেশে যেতে এবং ফিরতে দুর্ভোগের শেষ নেই তাদের। বিমান বন্দরে প্রবেশ করেই তারা হয়রানির মুখে পড়েন। কাস্টমস, ইমিগ্রেশন পুলিশের সঙ্গে দালাল ও প্রতারকচক্র তাদের পদে পদে হয়রানি করেন। হাতিয়ে নেন মূল্যবান জিনিসপত্র।
চান নগদ ডলার বা পাউন্ড। নানামুখী অত্যাচারে শিকার প্রবাসী বাংলাদেশি দেশে ফিরে এসব নিয়ে অভিযোগ করলেও সারাশব্দ নেই সংশ্লিষ্ট কারো। গত বুধবার মধ্যপ্রাচ্য থেকে ফিরেছেন একজন প্রবাসী। তিনি বলেন,‘বিমান বন্দরের টার্মিনালের বাইরে আমার ছোট ভাই ও পরিবারের লোকজন আসছেন আমাকে নিতে, এখানকার কয়েজন আনসার সদস্যেরে সঙ্গে তাদের কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে তারা আমার ছোট ভাইয়ের গায়ে হাত তুলে। ভিতরে কি পরিমান হয়রানি হতে হয় তা বাদ দিলাম।
বের হয়ে যে একটা টেক্সি নিবো তার উপায় নেই। দুইশ’ টাকার ভাড়া হাজার টাকা পর্যন্ত চেয়ে বসে। লাগেজ নিয়ে করে টানাটানি। তারা মনে করে বিদেশ থেকে আমরা কোটিপতি হয়ে আসি। পদে পদে টাকা চায়’। হাজারো প্রবাসী প্রতিদিন শিকার হন এমন হয়রানির। বিমান বন্দরটিতে আর্ন্তজাতিক ও অভ্যন্তরীণ রুট মিলিয়ে ৭৫-৮০টি বিমান ওঠানামা করে, গমনাগমন করে দেশি-বিদেশি হাজার হাজার যাত্রী। এদের বেশির ভাগই স্বল্পশিক্ষিত প্রবাসী শ্রমিক। এসব যাত্রীর জন্য আরও কয়েক হাজার দর্শনার্থী বিমানবন্দরে যাতায়াত করে। এযাত্রী ও দর্শনার্থীদের টার্গেট করেই হয়রানি বাণিজ্যের নানা প্রক্রিয়া সচল থাকে এখানে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিমান বন্দরে ১২ ধাপে এই হয়রানির শিকার হন তারা। প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকেও বিমানবন্দরে যাত্রী হয়রানি বন্ধের ব্যাপারে কঠোর নির্দেশনা দেয়া থাকলেও কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। কোনোভাবেই বন্ধ হচ্ছে না এ হয়রানি। বিমানবন্দরে প্রবেশের মোড় থেকেই শুরু হয় যাত্রী হয়রানি। যাত্রীসেবায় নিয়োজিত কাস্টমস, ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা, বিমানবন্দর অর্থাৎ পুলিশ ও বিভিন্ন বিভাগে দায়িত্বরতদের একটা বড় অংশের বিরুদ্ধে নিয়মিত যাত্রী হয়রানির অভিযোগ রয়েছে। এর মাঝে ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস নিয়ে মানুষ বেশি অতিষ্ঠ।
শুধু তাই নয়, ফিরতি যাত্রীরা কাস্টমস হলরুম থেকে বের হওয়ার পর ট্যাক্সিচালক, দালাল, ভুয়া গোয়েন্দা ও ছিঁচকে সন্ত্রাসীদের খপ্পরে পড়েও তাদের হয়রানি হতে হয়। যাত্রীরা বিদেশ গমনের সময় বহির্গমন লাউঞ্জের প্রবেশমুখে কর্তব্যরত একশ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর খপ্পরে পড়েন। প্রবাসীরা দীর্ঘ জার্নি শেষে বিমানবন্দরে পৌঁছে লাগেজের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হতো। এরপরও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে, আবার তা পাওয়া গেলেও এমনভাবে ছুড়ে ফেলা হয় যাতে ব্যাগেজের মালামাল নষ্ট হয়ে যায়। কখনো ব্যাগ ছিঁড়ে মালামাল পড়ে গেলে শুরু হয় লুটপাট। এদিকে বিদেশগামী যাত্রীদের বিমানবন্দরের দোতলার প্রবেশপথে দীর্ঘসময় লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। নিরাপত্তা তল্লাশির নামে যাত্রীদের এ ভোগান্তির মুখে পড়তে হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, যাত্রীদের লাগেজ সংগ্রহে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। অনেক সময় সংঘবদ্ধ চক্র লাগেজ গায়েব করে ফেলে। কোনো কোনো সময় লাগেজ কেটে ভেতরের মালামাল সরিয়ে ফেলা হয়। অনেক সময় যাত্রীদের লাগেজ আসেনি বলে জানানো হয়। বলা হয়, পরবর্তী ফ্লাইটে আসবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরবর্তী ফ্লাইটে লাগেজ এলেও লাগেজ প্রকৃত মালিকের কাছে পৌঁছানো হয় না। লস অ্যান্ড ফাউন্ড বিভাগও যাত্রী হয়রানির শাখা হয়ে দাড়িয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, এ শাখার সদস্যরা কেউই যাত্রীদের সঙ্গে ভালো আচরণ করেন না। লস অ্যান্ড ফাউন্ড শাখা পরিচালনা করে বিমান কর্তৃপক্ষ।
হারানো মালামাল পাওয়া গেলে কয়েক মাস সেগুলো দেখভাল করেন লস অ্যান্ড ফাউন্ড এর কর্মকর্তারাই। এরপর মালামালের মালিক না পাওয়া গেলে সেগুলো কাস্টমস গোডাউনে জমা দেয়া হয়। কিন্তু মালামাল হারানো যাত্রীরা লিখিত আবেদন দাখিল করলেও মালামাল পাওয়া, না পাওয়া নিয়ে তাদের আর কিছু জানানোর চেষ্টাও করে না লস অ্যান্ড ফাউন্ড বিভাগ। অভিযোগ রয়েছে, অনেক সময় নিজেদের লোককে সংশ্লিষ্ট যাত্রী সাজিয়ে মালামাল তুলে নেয়ার তারা। এ বিষয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের জনসংযোগ বিভাগের প্রধান ও ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার তাহেরা খন্দকার বলেন,‘এধরনের কোনো অভিযোগ আমাদের কাছে আসে না। যদি আসে তাহলে আমাদের পক্ষ থেকে সর্বাত্বক সহযোগিতা করবো। এরচেয়ে বেশি কিছু জানতে চাইলে বলেন, আপনি তথ্য অধিকার আইনে একটি আবেদন করলে আমরা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে আপনাকে জানাতে পারবো।’এদিকে যাত্রীদের অতিরিক্ত মালামাল থাকলে শুরু হয় আরেক ধরনের হয়রানি। সমঝোতার পর মালামাল বেল্টে পাঠিয়ে যাত্রীর বোর্ডিং পাস ইস্যু করা হয়।
এর আগ পর্যন্ত বোর্ডিং পাস ঝুলিয়ে রাখা হয়। এরপর যাত্রীরা বিমানবন্দরের অভ্যন্তরে থাকা ব্যাংক থেকে যে দেশে যাচ্ছেন সে দেশের মুদ্রা সংগ্রহ করতে গিয়ে চূড়ান্ত হয়রানির শিকার হন। ভুক্তভোগী যাত্রীরা জানান, মূলত ইমিগ্রেশন পুলিশের হয়রানির শিকার হয়ে বহির্গামী যাত্রীদের নাভিশ্বাস। দেশ থেকে যাওয়া অল্পশিক্ষিত প্রবাসী যাত্রীদের নানা প্রশ্ন করে তাদের আটকে রাখাটা এখানে অলিখিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে ইমিগ্রেশন পুলিশের দক্ষতা নিয়েও। লাগেজে দামি মালামাল থাকলে তো কথাই নেই। যাত্রীর মালামাল স্ক্যানিংয়ের নামে গ্রিন চ্যানেল অতিক্রম করতে অযথাই দেরি করানো হয়। এতে বিরক্ত হয়ে যাত্রীরা অনেক সময় টাকার বিনিময়ে মালামাল স্ক্যানিং ছাড়াই বেরিয়ে আসেন। নামপ্রকাশ না করার শর্তে ইমিগ্রেশন পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘টুকটাক ঝামেলা হয়।
বিমানবন্দর খুব সেনসিটিভ জায়গা। এখানে কড়া নিরাপত্তরা মধ্য দিয়ে চলতে হয়। সেক্ষেত্রে অনিচ্ছাকৃত অনেক ঝামেলা ফেস করতে হয় আমাদের। এর বেশি কিছু না। ’তবে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা বলছেন, মাত্র ২২টি কাউন্টারেই যাত্রীসেবার সব কাজ সম্পন্ন করা হয়। সেখানে নতুন কাউন্টার বসানোরও জায়গা নেই। পিকআওয়ারে যখন ৫-৬টি বিমান স্বল্প সময়ের ব্যবধানে অবতরণ করে তখন যাত্রীদের দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতে হয়। তবে বেশীরভাগ যাত্রীরাই নিয়মকানুন না জানার কারনে অনেক ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। অনেক সময় দেখা যায়, তাদের কারনেই তারা ভোগান্তির শিকার হয়। শুধু ইমিগ্রেশন নয়, শাহজালালের প্রতিটি ঘাটেই যাত্রীদের নানা ভোগান্তি পোহাতে হয়। এদিকে কাস্টম হয়রানি এখন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে ঢাকা কাস্টমস হাউসের সহকারী কমিশনার(বিমান বন্দর দায়িত্বপ্রাপ্ত) মো.সোলাইমান হোসেন। তিনি বলেন,কাস্টমসে হয়রানি করার কোনো সুযোগই নেই। কাস্টমসের কাজ হচ্ছে যাত্রীরা ইমিগ্রেশন থেকে বের হওয়ার পর ব্যাগেজ সংক্রান্ত। এর বাইরে হেরফের হলে আমাদের কাজ করতে হয়। সরকারতো এই জন্যই আমাদের রেখেছে।
তাছাড়া এখন গ্রিন চ্যানেল ও ব্যাগেজের কাউন্টারে মনিটরিং জোরদার করা হয়েছে। জানা যায়, বিমানবন্দরে আর্মড পুলিশের দায়িত্ব্ব বহির্গমন ,পার্কিং লট ,ক্যানোপি, কনকর্স হল, আগমনী কনভেয়ার বেল্ট, টারমাক, রানওয়ে, ড্রাইওয়ে ও অ্যাপ্রোন এলাকায় নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত থাকা। তবে তারা অধিকাংশ সময়ই ব্যস্ত থাকে আগমনী আর কার পার্কিং এলাকায় যাত্রীদের মালামাল তল্লাশির কাজে। বিদেশ থেকে আসা অনেক যাত্রী বিমানবন্দরে সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে গাড়িতে ওঠার পরই এই আর্মড পুলিশের তল্লাশির মুখোমুখি হন। টানাহিঁচড়া করে আবার বিমানবন্দরের ভিতরে নেওয়ার নজিরও আছে। এপিবিএন পুলিশ ও সিভিল টিম সদস্যরা শাহজালালে বহির্গমন যাত্রীদের ভিসা, পাসপোর্ট, টিকিট চেকিংয়ের নামে এসব হয়রানি করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ দায়িত্ব ইমিগ্রেশন পুলিশের হলেও তারা অনধিকার চর্চা করে বলে অভিযোগ রয়েছে। অন্যদিকে আর্মড পুলিশ কর্তৃক নিরাপত্তাবিষয়ক অতিরিক্ত বাড়াবাড়িতে যাত্রী হয়রানি বেশি হচ্ছে । এ বিষয়ে পুরো দ্বিমত পোষন করেছেন আর্মড পুলিশের কমান্ডিং অফিসার মো.রাশেদুল ইসলাম। তিনি বলেন ,‘এই পর্যন্ত বিশ পচিশজনের চাকরি গেছে শুধুমাত্র যাত্রীদের সঙ্গে উচ্চ স্বরে কথা বলার জন্য।
হয়রানি তো পরের কথা। তবে এসব অভিযোগ যারা করছে দেখবেন তাদের বেশির ভাগই অপরাধের জড়িত, মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত। কারন তাদেরকে আমরা সুযোগ সুবিধা দেই না। এপিবিএন এর কেউ যদি হয়রানি করে থাকে এটা তাদের ব্যাক্তিগত সমস্যা। তারপরও যদি আমার কানে আসে তাহলে আমি সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেই।’এদিকে অভিযোগ রয়েছে ,নির্ধারিত অনুমোদিত ট্যাক্সিক্যাবের বাইরে অননুমোদিত বেশকিছু কার ও মাইক্রোবাসও বিমান বন্দরের সামনে নিয়মিত ভিড় করে। এগুলো নিয়ন্ত্রণে নেই কোনো উদ্যোগ। তাছাড়া বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন ডেস্ক কর্মকর্তাদের প্রযুক্তি দক্ষতা কম, কাজে গতি নেই ফলে তৈরি হচ্ছে পদে পদে সময়ক্ষেপণ আর ভোগান্তি ।
Discussion about this post