আলোচিত মাদরাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় সক্রিয় ভূমিকা রাখায় সাংবাদিকদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দিলেন ফেনীর সাবেক পুলিশ সুপার (এসপি) এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার। তিনি মীমাংসিত মামলায় চার্জশীট দেয়াসহ অন্তত ১০ টি মামলায় সাংবাদিকদের ফেঁসে দিয়েছেন।
নুসরাত হত্যাকাণ্ডের পর তার দায়িত্বে অবহেলার বিষয়টি গণমাধ্যম তুলে ধরলে তাকে ফেনী থেকে প্রত্যাহার করা হয়। এতে ক্ষেপে যান এসপি জাহাঙ্গীর সরকার। ফেনী ছেড়ে যাওয়ার সময় তিনি ‘জেদ মিটিয়ে গেছেন’ জেলার সাংবাদিকদের ওপর। তার অধীনস্থ বিভিন্ন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের (ওসি) ডেকে কয়েকজন সাংবাদিককে মামলায় ফাঁসিয়ে দিয়ে গেছেন জাহাঙ্গীর সরকার । এমনকি প্রায় মীমাংসার পথে থাকা মামলার চার্জশিটেও সাংবাদিকদের নাম ঢুকিয়ে দিতে বাধ্য করেছেন তিনি।
যুগান্তরের ছাগলনাইয়া প্রতিনিধি নুরুজ্জামান সুমন, ছাগলনাইয়া ডটকমের সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির লিটনসহ তিন জনের নামে ২০১৬ সালের ১৭ মার্চ এক মাদ্রাসা শিক্ষক তথ্য প্রযুক্তি আইনে মামলা করেন। আবার ওই বছরের ৮ জুলাই মামলার বাদি সাংবাদিকদের সঙ্গে লিখিতভাবে মীমাংসা করে ফেলেন। পরদিন আপোসনামা থানা ও আদালতে জমা দেয়া। কিন্তু নুসরাত হত্যার পর এসপি জাহাঙ্গীর সরকারের ভূমিকা নিয়ে বারবার নিউজ করায় সাংবাদিকদের উপর ক্ষুব্ধ হন তিনি। যুগান্তর প্রতিনিধির মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছাগলনাইয়া থানার ইন্সপেক্টর সুদ্বীপ রায় সাড়ে ৩ বছর পর আবার আইসিটি মামলার তদন্ত শুরু করেন। হঠাৎ তদন্ত কেন এমন প্রশ্নে তিনি সাংবাদিকদের জানান, এসপি স্যার নির্দেশ দিয়েছেন দ্রুত চার্জশীট জমা দিতে। বাদির কোন মতামত না নিয়ে সম্পূর্ণ ডাহা মিথ্যা তথ্য দিয়ে এবছরের ২৭ মে আদালতে চার্জশীট জমা দেন সুদ্বীপ রায়। এঘটনা জানাজানি হলে সাংবাদিকরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। পরে একে একে জানতে পারেন আরো চার সাংবাদিককেও মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ফেনী মডেল থানায় ৩, সোনাগাজী মডেল থানায় ২, দাগনভূঞা থানায় ২ ও ছাগলনাইয়া থানায় ২টি মামলার চার্জশিট আদালতে জমা দেয়া হয়েছে । এসব মামলার অধিকাংশই বাদী পুলিশ। জমা দেওয়া চার্জশিটে যুগান্তর সাংবাদিকছাড়াও দৈনিক ফেনীর সময় ও সাপ্তাহিক আলোকিত ফেনীর সম্পাদক মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন, দৈনিক অধিকার প্রতিনিধি ও অনলাইন পোর্টাল ফেনী রিপোর্ট’র সম্পাদক এস এম ইউসুফ আলী, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমের স্টাফ করেসপন্ডেন্ট সোলায়মান হাজারী ডালিম এবং দৈনিক সময়ের আলো প্রতিনিধি ও দৈনিক স্টার লাইনের স্টাফ রিপোর্টার মাঈন উদ্দিন পাটোয়ারীর নাম রয়েছে।
তদন্ত সূত্র জানায়, মামলার এজাহারে এদের কারও নাম না থাকলেও বিস্ময়করভাবে চার্জশিটে তাদের নাম ঢোকাতে ওসিদের বাধ্য করেন এসপি জাহাঙ্গীর সরকার।
সংশ্লিষ্টরা জানান, উল্লিখিতদের নামে ফেনীর কোনো থানায় ইতিপূর্বে সাধারণ ডায়েরিও ছিল না। বিতর্কিত এসপি জাহাঙ্গীর সরকারের রোষানলে পড়ে এক সপ্তাহের মধ্যে তারা প্রায় ১০টি মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি হয়ে যান। বিষয়টি জানাজানি হলে ফেনীতে কর্মরত সাংবাদিক ও সচেতন মহলে ক্ষোভ-অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে।
এ বিষয়ে ফেনী প্রেসক্লাবের সভাপতি আসাদুজ্জামান দারা বলেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এ ধরনের উদ্দেশ্যমূলক চার্জশিট দাখিল খুবই দুঃখজনক ঘটনা। পুলিশ-সাংবাদিক একে অপরের শত্রু নয়। কিন্তু এ ধরনের ঘটনা পুলিশ এবং সাংবাদিকদের মধ্যে বৈরিতার সৃষ্টি করবে। পেশাদার সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে পুলিশের এমন বিরূপ আচরণ কাম্য নয়। ফেনী প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ও প্রবীণ সাংবাদিক নুরুল করিম মজুমদার বলেন, এ ধরনের ঘটনা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করে। পেশাদার সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যমূলক চার্জশিট জমা দেখে আমরা আশ্চর্য হয়েছি, হতভম্ব হয়েছি। আমরা এ ঘটনায় তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করছি।
ফেনী রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি আরিফুল আমিন রিজভী বলেন, কিছু অতি উৎসাহী পুলিশ হয়রানি করার জন্যে উদীয়মান তরুণ সাংবাদিকদের মামলায় জড়িয়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে হরণ করার চেষ্টা করেছে। এ ধরনের ঘটনা খুবই নিন্দনীয়। আমরা এ ঘটনায় তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। ফেনীর সময় সম্পাদক শাহাদাত হোসেন জানান, নুসরাত হত্যাকাণ্ডের পর সিরিজ নিউজ করে ফেনীর সময়। এজন্য এসপি জাহাঙ্গীর সরকার ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে বিভিন্ন মামলায় চার্জশীটভুক্ত করেছে। ফেনীর ইতিহাসে কোন এসপি এরআগে এধরণের নিন্দনীয় কাজ করেননি।
সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছেন, নুসরাত হত্যার রহস্য উদঘাটন ও সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব পালনে অবহেলা তুলে ধরতে সক্রিয় ভূমিকার কারণেই এসপি জাহাঙ্গীর অনৈতিকভাবে ‘খেদ মিটিয়েছেন’ পেশাদার সাংবাদিকদের ওপর।
বিভিন্ন সূত্র এবং নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ওসির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এজাহারে নাম না থাকা সত্ত্বেও চার্জশিটে সাংবাদিকদের নাম ঢোকাতে সংশ্লিষ্ট থানার ওসিদের এসিআর আটকে রাখেন পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর সরকার। এসব মামলার চার্জশিটে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের নাম বাদ দিয়ে সুকৌশলে সাংবাদিকদের নাম ঢোকাতে বাধ্য করেন জাহাঙ্গীর।
এসপি ১২ মে সন্ধ্যায় তার বদলি আদেশ আসার পর তিনি রাতে জরুরি ভিত্তিতে ওসিদের ডেকে চাপ প্রয়োগ করে কয়েকটি চার্জশিট তৈরি করান এবং পরদিন তা দাখিলে বাধ্য করেন বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ওসি জানান। এমনকি বিষয়টি গোপন রাখতেও কোর্ট পরিদর্শকসহ অন্যদের নির্দেশ দেন তিনি।


























