বলিউডে অমিতাভ বচ্চনকে ধরা হয় কিংবদন্তীর একক। সত্তরের দশকে তার যে জনপ্রিয়তা ছিল, সেটা এর আগে কেউ তৈরি করতে পারেননি৷ এখন তিন খানের যে জনপ্রিয়তা, সেটার চেয়েও হয়তো তখন বেশি জনপ্রিয় ছিলেন বিগ বি। শোলে, দিওয়ার বা ডন সিনেমার ডায়লগগুলো এখনও লোকের মুখে ঘুরে ফেরে, নতুন সব সিনেমাতেও কখনও কখনও ব্যবহার করা হয় সেগুলো৷ একজন অমিতাভ বচ্চনের জন্ম না হলে শাহরুখ-সালমান আমিরেরা হয়তো এতটা জনপ্রিয় হতেন না। কে জানে, এরা না এলে বলিউডই হয়তো এতটা প্রভাবশালী ইন্ডাস্ট্রিতে পরিণত হতো না।
শাহরুখ এখনও নানা সময় বলেন, অমিতাভ বচ্চন ছিলেন তাদের সময়ের আদর্শ। আবার শাহরুখদের পরের প্রজন্মটা তো তিন খানকে দেখেই বেড়ে উঠেছে, তারা শাহরুখের মতো রোমান্স করতে চেয়েছে, আমিরের মতো অভিনয়ে পর্দা মাতিয়ে রাখতে চেয়েছ, সালমানের তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা তাদের মুগ্ধ করেছে৷ হালের সেনসেশন রাজকুমার রাও অকপটেই স্বীকার করেন, শাহরুখের অভিনয় দেখেই তিনি অভিনয়ের অনুপ্রেরণা পেয়েছেন৷ আয়ুশমান খুরানা, সুশান্ত সিং রাজপুত বা আরও যারা আউটসাইডার আছেন, তাদের জিজ্ঞেস করলেও কাছাকাছি উত্তরটাই পাওয়া যাবে৷ ইন্ডাস্ট্রির সুপারস্টারদের দেখেই তারা অভিনয়ে এসেছেন, সিনেমাজগতে পা রাখার স্বপ্ন দেখেছেন।
ভূমিকাটা অনেক বেশি দীর্ঘ হয়ে গেল। এতসব কথা বললাম আমাদের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির পরিপ্রেক্ষিতে৷ সালমান শাহ মারা যাওয়ার পরে আক্ষরিক অর্থেই বাংলাদেশী চলচ্চিত্র শিল্পে একটা শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল, যেটা আজও পূরণ হয়নি। এরপরে রিয়াজ বা মান্নারা ব্যবসাসফল সব সিনেমা উপহার দিয়েছেন, জনপ্রিয়তাও পেয়েছেন। তবে সেটা সালমান শাহ’র কাছাকাছি ছিল না। ২০০৯ সালে মান্নার অকালমৃত্যু আর রিয়াজের চলচ্চিত্র থেকে ধীরে ধীরে সরে যাওয়ার পরে সিনেমাজগত মোটামুটি একজনের ওপরেই নির্ভর হয়ে পড়েছিল, তিনি শাকিব খান।
গত একযুগ ধরে শাকিবই দেশের এক নম্বর নায়ক, একমাত্র সুপারস্টার বললেও ভুল হবে না। আর কোন প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় দীর্ঘ অনেকগুলো বছর ধরে শাকিব যা করেছেন, সেটাই তার দর্শকেরা গ্রহণ করেছেন, কিংবা করতে বাধ্য হয়েছেন৷ আমি আপনি শাকিবকে নিয়ে যতো হাসিঠাট্টাই করি, তার কিন্ত নির্দিষ্ট একটা ফ্যানবেজ আছে, নির্দিষ্ট দর্শক আছে। কাজেই শাকিব যখন শ্যুটার বা পাংকু জামাইয়ের মতো বস্তাপচা সিনেমাগুলো করছেন, তখনও তারা হলে গিয়ে দেখছেন সেগুলো৷ একটানা তামিল-তেলুগু সিনেমা থেকে কপি করে গেলেও সিনেমা হলগুলো বেঁচে আছে শাকিবের সিনেমাকে উপজীব্য করেই, এই কথাটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই৷
মাঝে আরিফিন শুভ এসেছিলেন, এখনও আছেন তিনি৷ কিন্ত শাকিবের জনপ্রিয়তাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো অবস্থায় যেতে আরও অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে তাকে৷ উল্টো ‘একটি সিনেমার গল্প’ টাইপের সিনেমা করে নিজেকেই নিজে ব্যকফুটে ঠেলে দিয়েছেন তিনি৷ তবুও আরিফিন শুভর প্রতি আমাদের ভরসাটা আছে এখনও। ইন্ডাস্ট্রিতে বাকি যেসব নায়কেরা আছেন, বাপ্পী, সায়মন৷ জায়েদ খান বা অন্যরা, এদের কেউই সব শ্রেনীর দর্শকের কাছে সমান গ্রহণযোগ্যতা পাননি। তাদের অভিনয়প্রতিভা নিয়েও আছে অনেক সমালোচনা।
সেই সময়েই সিয়াম আহমেদের উত্থান৷ নাটক থেকে সিনেমায় আসা এই অভিনেতা তার প্রথম সিনেমা দিয়েই দর্শকের কাছে পৌঁছে গিয়েছেন খুব ভালোভাবেই৷ এবছরের সবচেয়ে ব্যবসাসফল সিনেমার তালিকা করতে বসলে ‘পোড়ামন-২’ কে রাখতে হবে সবার ওপরেই। মুক্তির পরে টানা চৌদ্দ সপ্তাহ ধরে প্রদর্শিত হয়েছে সিনেমাটা, গত কয়েক বছরের ইতিহাস ঘাঁটলে যেটাকে বেশ বিরল একটা ঘটনাই বলা চলে। পূজা চেরির সঙ্গে তার জুটিটাও বেশ ভালোভাবে গ্রহণ করেছে দর্শক। সিনেমাটা মাল্টিপ্লেক্সে মোটামুটি ব্যবসা করলেও, সিঙ্গেল স্ক্রীনগুলোতে চলেছে দাপট দেখিয়ে৷ অর্থাৎ সাধারণ দর্শক বেশ পছন্দ করেছেন ‘পোড়ামন-২’ কে, সেই সঙ্গে সুজন শাহরূপী সিয়ামকেও।
সেই সিয়াম এবার নিয়ে আসছেন নিজের দ্বিতীয় সিনেমা ‘দহন’৷ একই প্রযোজক, একই পরিচালক, নায়িকাও এক, তবে সিনেমার ধরণ আর গল্প পুরোপুরি আলাদা। নিজের প্রথম সিনেমায় রোমান্টিক ইমেজেই দেখা গিয়েছিল সিয়ামকে, নাটকেও এমন চরিত্রে তিনি অভিনয় করেছিলেন অনেকবার৷ তবে দ্বিতীয় সিনেমায় এসেই পরিচিত সেই সেফ জোনটা ছেড়ে অনেকটাই যেন বেরিয়ে এলেন সিয়াম। দহনে তার চরিত্রের নাম তুলা, মাদকাসক্ত এই যুবকের মধ্যে প্রেমিক স্বত্বা যেমন আছে, তেমনই আছে একটা খুনী সত্বাও। সিয়ামের চকলেট বয় ইমেজের সঙ্গে এটা তো ভীষণ রকমের বেমানান!পোড়ামন-২ যে পর্যায়ের ব্যবসায়িক সাফল্য পেয়েছিল, সেটার ধারাবাহিকতা ধরে রেখে সিয়াম চাইলেই আরও দশটা রোমান্টিক সিনেমায় নাম লেখাতে পারতেন, নিজের পরিচিত গণ্ডিতে থেকেই নিরাপদে ডিফেন্সিভ খেলতে পারতেন৷ সেটা না করে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় সিনেমাতেই সিয়াম ঝুঁকি নিয়েছেন, মাদকাসক্ত এক তরুণের ভূমিকায় অভিনয় করার সেই ঝুঁকিটা নেয়া সাধারণ কোন ব্যাপার ছিল না৷
হোক না নায়ক, তবুও চরিত্রের এই নেগেটিভ অংশটা দর্শক কতটুকু মেনে নেবে এটা উপমহাদেশের অনেক নায়কই দশবার ভাবেন৷ খোদ সালমান খান এখনও ডার্ক শেডের কোন ক্যারেক্টারে অভিনয় করতে চান না, নায়কদের মধ্যে এরকম ভাবনা থাকেই। সিয়াম তার ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই নিজেকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন, ভিন্নধর্মী চরিত্রে অভিনয় করে নিজের সক্ষমতার জানান দিচ্ছেন, জয় করছেন ভয়কে। সিয়ামের পরের সিনেমাটা ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে, তৌকির আহমেদের পরিচালনায়, সিনেমার নাম ‘ফাগুন হাওয়ায়’। বাণিজ্যিক ঘরাণার কাজের সঙ্গে এরকম গল্প বা ইতিহাসনির্ভর সিনেমার অংশ হওয়াটাও দারুণ কৃতিত্বের। ডিসিশান মেকিঙের সেই কৃতিত্বটা সিয়াম অবশ্যই পাবেন৷
ক্যারিয়ারের শুরুতে শাহরুখ খান এন্টি হিরো টাইপের রোলে অভিনয় করেছিলেন৷ ডর, বাজিগর- এই সিনেমাগুলোতে তিনি প্রথাগত নায়ক ছিলেন না৷ নায়িকাকে ছাদ থেকে ফেলে দেয়ার মতো কাজ করেছেন অবলীলায়। নিজের ক্যারিয়ারের প্রথম সিনেমায় সিয়াম তার নায়িকাকে কুপিয়েছেন, দ্বিতীয় সিনেমায় হয়তো পুড়িয়ে মারতে চলেছেন, দহনের ট্রেলার দেখে সেরকমটাই মনে হয়েছে৷ চাইলে শাহরুখ খানের সঙ্গে সিয়ামের ক্যারিয়ারের শুরুর এই ব্যাপারটা মেলাতেই পারেন।
আরেকটা জায়গায় সিয়াম বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অন্যদের চেয়ে বেশ খানিকটা আলাদা। আমাদের নায়কদের মধ্যে সেন্স অফ হিউমার খুব একটা নেই। কেউ নিজেকে সুপারস্টার দাবী করে মুখে ফেনা তোলেন, কেউবা তার সিনেমা নিয়ে সমালোচনা হলে সেটা সহ্যই করতে পারেন না। অথচ টক-শো কিংবা ইন্টারভিউ সেশনগুলোতে সিয়ামের কথাবার্তা এবং অভিব্যক্তি আলাদা করে নজর কাড়ে৷
ভীষণ গুছিয়ে কথা বলার দারুণ একটা গুণ আছে তার, তিনি মজা করে আসর জমাতে পারেন, উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে দারুণভাবে সামলাতে পারেন বাউন্সার এবং ইয়র্কারের মতো ছুটে আসা প্রশ্নগুলো। শাহরিয়ার নাজিম জয়ের ‘সেন্স অব হিউমার’ অনুষ্ঠানে সেটার প্রমাণ কিছুদিন আগেও তিনি দিয়েছেন৷ আরও কিছু ইন্টারভিউতে তার কথাবার্তা শুনে মুগ্ধ হয়েছি৷ মেলাতে চাইছি না, তবুও মনে করিয়ে দিই৷ দারুণ এই গুণটি কিন্ত শাহরুখ খানেরও আছে!
লেখার শুরুতে সুপারস্টারদের কথা বলছিলাম। ক্রিকেট হোক কিংবা সিনেমা, যেকোন ফিল্ডে সুপারস্টার কয়েকজন থাকাটা খুব দরকার। তাহলে পরবর্তী প্রজন্ম সেই ক্ষেত্রটায় পা রাখার ব্যাপারে আগ্রহী হন। সিয়ামের কাছে যেমন সালমান শাহ ছিলেন আদর্শ৷ আমাদের দেশের হাজার হাজার কিশোর-তরুণ যেমন সাকিব-মাশরাফির মতো ক্রিকেটার হতে চায় এখন৷ সিনেমায় তারকার অভাব আছে আমাদের, ক্যারিয়ারের শুরু থেকে সিয়াম যেভাবে হাঁটছেন, তাকে বাংলা সিনেমার নেক্সট বিগ থিং ভাবলে দোষের কিছু নেই৷
ঝুলিতে মাত্র দুটো সিনেমা, একটা এখনও মুক্তি পায়নি, তবুও কেন এতসব বলা? কারণ সিয়ামের মধ্যে সম্ভাবনার অফুরন্ত বারুদ আছে, আছে ভালো করার অদম্য একটা ইচ্ছা, আছে দর্শকের ভালোবাসা পাবার আকাঙ্ক্ষা। সেসব দিয়েই সিয়াম আমাদের ইন্ডাস্ট্রির নেক্সট সুপারস্টার হয়ে উঠবেন, এমনটাই প্রত্যাশা। সিয়ামকে দেখে হাজারও তরুণ সিয়ামের মতো হতে চাইবেন, সেটার সুফল তো বাংলাদেশী চলচ্চিত্র পাবে নিশ্চয়ই…
সেলিব্রেটিবিডি/ এইচআর
Discussion about this post